পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। সেইসঙ্গে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী দেশের সেরা সেরা কোম্পানির বিলাসবহুল লঞ্চ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। হঠাৎ করে যাত্রী কমে যাওয়ায় অনেকটা বিপাকেও পড়ে মালিকপক্ষ। যাত্রীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রস্তাব দেওয়া হয় ভাড়া কমানোর। 

বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দফায় দফায় বৈঠক হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাড়া না কমাতে অনড় মালিকপক্ষ। বরং যাত্রীসেবার মান বাড়াতে রাজি হলেও ভাড়া কমানোর প্রস্তাব সবাই নাকচ করেছেন। মূলত দুটি যুক্তিতে ভাড়া কমানোর বিবেচনা থেকে সরে এসেছেন তারা।

তবে বিআইডব্লিউটিএ বরিশাল নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ লঞ্চ মালিকদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ঈদুল আজহায় যাত্রীদের ভাড়া পূর্বনির্ধারিত থাকলেও পর্যায়ক্রমে ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

ঈদুল আজহার আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত লঞ্চ মালিকদের বৈঠকের বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন লঞ্চ মালিকের সঙ্গে। তবে নাম প্রকাশ করতে চাননি তারা।

এর মধ্যে একটি শিপিং লাইন্সের মালিক জানিয়েছেন, বাস সেক্টরের সঙ্গে লঞ্চের তুলনা না হলেও পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সময় সড়ক পথ জনপ্রিয় হচ্ছে। এতে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে লঞ্চের ওপর। এক ধাক্কায় দুই তৃতীয়াংশ যাত্রী কমে যায়। সংকট কাটাতে সকলে আলোচনায় বসেন। আলোচনায় দুটি বিষয় উঠে আসে।

এর মধ্যে একটি হচ্ছে, দক্ষিণাঞ্চলে যে পরিমাণ লোক ঢাকা ও ঢাকা হয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যাতায়াত করেন তা পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত বাস নেই ঢাকা-বরিশাল রুটে। ফলে পদ্মা সেতু রাজধানীর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনলেও যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে পারছে না বাস। এজন্য মানুষ লঞ্চে যাতায়াত অব্যাহত রাখবে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চ দুর্ঘটনার হার একেবারে কম। যা ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয় তাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। 

দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে ওই লঞ্চ মালিক বলেন, একটি বাসে দুর্ঘটনা হলে যত যাত্রী থাকেন তারা সকলেই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর প্রাণহানির পরিসংখ্যানও সড়কে বেশি। সে তুলনায় ঢাকা-বরিশাল রুটের বিলাসবহুল লঞ্চে বড় কোনো দুর্ঘটনা বা প্রাণহানির দৃষ্টান্ত বিগত দুই দশকেও নেই।

মালিকদের যুক্তি, যাত্রীরা জানেন সপরিবারে যাতায়াতের সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল লঞ্চ রুট। একজন যাতায়াতে বাস প্রথম পছন্দ হলেও সপরিবারে যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য ধরে রেখেছে লঞ্চগুলো। এজন্য সুযোগ থাকলেও ভাড়া কমানোর পক্ষে সম্মত হননি মালিকরা।

আরেকটি শিপিং লাইন্সের মালিক বলেন, এই দুটি যুক্তিতে সকলেই অনড় ছিলাম। তাছাড়া একটি লঞ্চ এক ট্রিপ দিতে যে টাকা খরচ হয় তা কমপক্ষে ২০টি বাসের চেয়েও বেশি। এজন্য বাসগুলো চাইলেই ভাড়া কমাতে পারেন। কিন্তু আমাদের সুযোগ নেই। বর্তমানে আমরা লঞ্চে যাত্রী ধরে রাখতে আরও আধুনিক যাত্রীসেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া যুক্ত করতে চাই। তাছাড়া পদ্মা সেতুর প্রভাবে যাত্রীখড়া থাকবে সর্বোচ্চ ৬ মাস। আমরা এটা ধরেই নিয়েছি। এরপর ঠিকই পুরোনো রূপে ফিরবে লঞ্চগুলো।
 
ঈদুল আজহায় কর্মস্থলে ফিরতে লঞ্চের আগের চিত্র উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ স্বভাবতই আরামপ্রিয়। এই দুর্বলতার জায়গা থেকে লঞ্চের চাহিদা কখনো কমবে না। মানুষ লঞ্চে গন্তব্যে যেতে পারে আবার ভ্রমণও হয়ে যায়। বাসে যাতায়াত করতে গেলে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। অথচ লঞ্চের যাত্রা সাধারণত রাতে হয়। ঘুমানোর সময়ে। এই সময়ে কারও কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় না। সুতরাং কোনো কিছুই লঞ্চের চাহিদা নষ্ট করতে পারবে না। যেহেতু লঞ্চের চাহিদা মানুষের মাঝে রয়েছে, এখানে শুধু শুধু লোকসান দেওয়ার মানে হয় না।

এই লঞ্চ মালিক বলেন, বিভিন্ন সময় যাত্রীদের চাহিদার ওপর নির্ভর করে লঞ্চ মালিকরা ছাড় দিতে পারবেন। যেমন আমরা অনেক সময়ে ডেকের ভাড়া ২০০ টাকাও নিই। বাস্তবে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৪০০ টাকা। আবার ডাবল কেবিন আড়াই হাজার টাকা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে ১৮ শ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ১৪ শ টাকা হলেও এক হাজার টাকা নিই। যাত্রী ধরে রাখতে এই কৌশল নেওয়া যাবে। কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ কখনোই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি আদায় করবে না। 

বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, লঞ্চগুলো সারা বছর একই ভাড়া আদায় না করলে আসলে আমাদের করার কিছু থাকে না। যদি তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম আদায় করলে তখনতো সেটি ব্যক্তিগত বিষয়। কারণ কোনো লঞ্চ মালিক যদি কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করেন, সেটিতে আমাদের আপত্তি থাকার কথা না। 

এই কর্মকর্তা বলেন, লঞ্চ মালিকরা আমাদের জানিয়েছেন ঈদুল আজহা পর্যন্ত পূর্ব নির্ধারিত ভাড়া থাকবে। যেহেতু পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে, এর একটি প্রভাব লঞ্চ সেক্টরে পড়েছে। এ কারণে যাত্রী ধরে রাখতে ঈদুল আজহার পরে কিছুটা ভাড়া কমাবেন। তবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর