রূপের রানি বলা হয়ে থাকে রাঙামাটি জেলাকে। প্রকৃতি যেন সব সৌন্দর্য দুহাত ভরে দিয়েছে রাঙামাটিকে। সেই সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা হয়ে থাকে পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা ঝরনাগুলোকে, যা দেখতে মোহাবিষ্ট থাকেন হাজারো পর্যটক।

রাঙামাটিতে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য ঝরনা। তবে পাহাড়ের যে ঝরনাটি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য ঝরনার মতো প্রসিদ্ধ, সেটি হলো ‘শুভলং ঝরনা’। বছরের অন্যান্য সময়ে এখানে পানি না থাকলেও, বর্ষা মৌসুমে তা পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। প্রায় ৩০০ ফুট ওপর থেকে পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে আসে শুভ্র জল এবং সেই জল গিয়ে মেশে কাপ্তাই হ্রদে।

শুভলং ঝরনা দেশের একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত উঁচু পাহাড়ি ঝরনা। এটি বৃহত্তর রাঙামাটির বরকল উপজেলার ১ নম্বর শুভলং ইউনিয়নের চিলারডাক নামক স্থানে কাপ্তাই হ্রদের কোল ঘেঁষে অবস্থিত। নৌপথে শুভলং বাজার যাওয়ার আগে দেখা মেলে সুবিশাল জলরাশির। এখানে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে হাজারো পর্যটকের সমাগম ঘটে।

রাঙামাটি শহর থেকে শুভলং ঝরনার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটারের মতো। শুকনো মৌসুমে শুভলংয়ে খুব সামান্য পরিমাণে পানি থাকে। তবে তীব্র খরা মৌসুমে ঝরনার পানি একেবারেই শুকিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে এর জলধারা প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে নিচে আছড়ে পড়ে। গড়িয়ে চলে যায় কাপ্তাই হ্রদে।

তবে এই ঝরনায় যাওয়ার জন্য সড়কপথে কোনো সুযোগ নেই, নৌপথই ভরসা। ট্যুরিস্ট বোট ভাড়া করে শহরের যেকোনো নৌঘাট থেকে এই ঝরনায় যাওয়া যায়। ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলোর ভাড়া সাধারণত ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে হয়। তবে বড় ট্রলার নিলে ভাড়ার পরিমাণ বাড়ে। এই ঝরনায় যেতে যেতে উপভোগ করা যায় আরও কিছু ছোট ঝরনা। পাশাপাশি সুন্দর ও সবুজ কিছু পাহাড়, পাহাড়ি গ্রাম আর কাপ্তাই হ্রদ ভ্রমণের আনন্দ তো আছেই।

সমান জনপ্রিয় ‘শুভলং ছোট ঝরনা’
শুভলংয়ে যাওয়ার পথে আরেকটি ঝরনা চোখে পড়ে। স্থানীয়ভাবে এটিকে ‘শুভলং ছোট ঝরনা’ বলা হয়। এর পানি প্রায় ৫০ ফুট ওপর থেকে নিচে পড়ে। এতদিন এটি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও কয়েক বছর ধরে এটিও সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেক সময় শুভলং ঝরনায় পানি কম থাকলেও ছোট ঝরনাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে পানি থাকে। স্থানীয় ভ্রমণপিপাসুদের পাশাপাশি পর্যটকদের কাছেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ছোট ঝরনাটি।

ঝরনাটিকে ঘিরে লোকসমাগম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রবেশপথের পাহাড়ে গড়ে উঠেছে স্থানীয় ফলমূল, বিভিন্ন শুকনো খাবার ও পানীয় জলের কিছু ছোট দোকান। পাহাড়ি গ্রামের বাসিন্দারা এসব দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন।

ঈদ উপলক্ষে পর্যটক সমাগম বেড়েছে এ দুটি ঝরনায়। শীতল জলের আনন্দ উপভোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসছেন রাঙামাটিতে।

রংপুর থেকে পরিবারসহ বেড়াতে আসা পার্থ সেন বলেন, পার্বত্য জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হচ্ছে শুভলং ঝরনা। যারা এই ঝরনা দেখবে না, তারা অনেক কিছুই মিস করবে। আমার সঙ্গে রাঙামাটির বাইরে থেকে যারাই এসেছেন, সবাই এই ঝরনা দেখে মুগ্ধ। বর্তমানে যে পরিমাণ পানি রয়েছে, আশা করি বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লে ঝরনার পানি আরও বাড়বে।

পর্যটক লাবণী বিশ্বাসও জানালেন তার উচ্ছ্বাসের কথা। তিনি বলেন, রাঙামাটির শুভলং ঝরনা আসলেই খুব চমৎকার। এটি জায়গাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ঝরনার পানি ও পানি পড়ার শব্দ দুটি দৃশ্যই মুগ্ধকর। আমরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করছি। এই বর্ষা মৌসুমে শুভলং ঝরনা ভ্রমণের জন্য অন্যদের আহ্বান জানান তিনি।

স্থানীয় যুবক মিত্র চাকমা বলেন, আমি এর আগেও অনেকবার শুভলং ঝরনায় এসেছি। এর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ বারবার এখানে টেনে নিয়ে আনে। সত্যিই খুবই চমৎকার একটি জায়গা।

শুভলংয়ের ইজারাদার জয় চাকমা জানালেন এ ঝরনাকে ঘিরে তার আশাবাদের কথা। তিনি বলেন, আমরা অপেক্ষা করে থাকি বর্ষা মৌসুম কখন আসবে। কারণ, বর্ষাকালে ঝরনাটি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হতে শুরু করে। বর্ষায় সে ফিরে পায় তার হারানো রূপ। আমরা আশা করছি, এখানে পর্যটক সমাগম আরও বাড়বে। 

যেভাবে যাবেন শুভলং ঝরনায়
শুভলং যাওয়ার জন্য রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজার, সমতাঘাট, তবলছড়িসহ শহরের নৌযান ঘাটগুলো থেকে বিভিন্ন ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, স্টিমার, ছোট-বড় লঞ্চ ও স্পিডবোট ভাড়া পাওয়া যায়। ভাড়া সাধারণত ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যেই হয়। তবে সেটা নৌযানের আকারের ওপর নির্ভর করে।

শুভলং ঝরনায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের কিছু স্থাপনা ও খাবারদাবারের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। তবে এখানে রাতে থাকার জন্য কোনো ধরনের হোটেল-মোটেল বা রিসোর্ট নেই। ঝরনায় প্রবেশের আগে দর্শনার্থীদের ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়।

এনএ