নড়াইলের লোহাগড়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচজনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার (১৮ জুলাই) নড়াইল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১-এর বিচারক মো. মোরশেদুল আলম এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন নড়াইল আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. নজরুল ইসলাম।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মো. সাঈদ শেখ (৫৫), মো. রাসেল মৃধা (৩৮), কবির গাজী (৪০), রেজাউল শেখ (৪০) ও মাসুম বিল্লাহ (৩০)।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি, দোকান ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনে গ্রেপ্তার পাঁচজনের সাত দিন করে রিমান্ড আবেদন করলে আদালত তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে।

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার (১৫ জুলাই) বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠে আকাশ সাহার বিরুদ্ধে। এ ঘটনার জেরে দিঘলিয়া বাজারে হিন্দুদের ছয়টি দোকান ভাঙচুর করা হয়। একটি বাড়িতে আগুন দেওয়াসহ তিনটি মন্দির ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া সাহাপাড়ার হিন্দুদের পাঁচটি বসতবাড়ি ও আসবাব ভাঙচুর করে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় লোহাগড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাকফুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করে রোববার (১৭ জুলাই) সকালে মামলা করেন। গত রাতে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত পাঁচজনকে লোহাগড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করা হয়।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে দাঙ্গা সংঘটনের অভিযোগ এনে সালাহ উদ্দিন কচি নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে লোহাগড়া থানায় আকাশ সাহাকে অভিযুক্ত করে শনিবার (১৬ জুলাই) রাতে মামলা করেন। শনিবার রাত সাড়ে ১১টায় খুলনার ডুমুরিয়া থেকে আকাশকে আটক করা হয়। রোববার (১৭ জুলাই) তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
 
এদিকে শনিবার ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও মন্দির পরিদর্শন করেছেন নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা। এ সময় তিনি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানান ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। একই সঙ্গে তালিকা করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও পরিবারের সঠিক সংখ্যা জানাতে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন তিনি। পাশাপাশি দোষীদের শাস্তি নিশ্চিতে ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতি আশ্বাস প্রদান করেন এ সংসদ সদস্য।

তিনি বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসন সর্বদা সচেষ্ট ছিল। অতিরিক্ত পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে কাজ করেছে। পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সব ইউনিট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। ভুক্তভোগীদের ক্ষতি যা হয়েছে, তা সমাধান করা গেলেই সমাধান হবে না, এই পরিস্থিতিতে তাদের মানসিক ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগবে। মানসিকভাবে ভীতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা তাদের আশ্বস্ত করছি ও চেষ্টা করছি, যাতে দ্রুত তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।

মাশরাফি আরও বলেন, এখানে আপনারা যারা বসবাস করছিলেন, এটুকু নিশ্চিত থাকেন আপনার স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতে পারবেন। এখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীরা আছেন। ইনশা আল্লাহ, আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।

এদিকে রোববার বিকেলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। এ সময় আগুনে পুড়ে যাওয়া গোবিন্দ সাহার পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা সহায়তা দেন তিনি।

ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, আমরা সবাই একসঙ্গে বসবাস করতে চাই। এই দেশ প্রত্যেকের। এ ধরনের হামলা উচিত নয়। নির্দিষ্ট একজনের দোষের জন্য সবার ওপর হামলা হওয়া উচিত না। বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটায় সংখ্যলঘুরা উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কগ্রস্ত। উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলা-মামলা বন্ধে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। আমরা আপনাদের পাশে থাকব। আপনারা আমাদের ভাইবোন।

এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. এম কে রায়ের নেতৃত্বে একটি দল এবং মাইনরিটি রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পবিত্র মিস্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় ও জেলার রাজনীতিকসহ বিশিষ্টজনরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

এদিকে সোমবার সকালে খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

স্থানীয় দিঘলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ বোরহান উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় প্রশাসন ও দলীয় নেতাকর্মীদের সাহসী ভূমিকায় বড় ধরনের নাশকতার থেকে দিঘলিয়াবাসীকে বাঁচানো গেছে। এখন এলাকার পরিবেশ স্বাভাবিক আছে। দোকানপাট গতকাল থেকে খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এলাকায় এখনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মোতায়েন আছে। সরকারি সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ও মন্দির মেরামত চলছে। অপকর্মকারীরা কোনো দল বা কোনো ধর্মের নয়, তারা যেকোনো খারাপ অবস্থায় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে ফায়দা নেওয়ার জন্য। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিচার প্রচলিত আইনে হোক, সেটা চাই।

এনএ