শাজাহান বিশ্বাস। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার গালা ইউনিয়নের কৌড়ি গ্রামের বাসিন্দা। এলাকার মানুষ ভালোবেসে তাকে ‘বৃক্ষপ্রেমী’ বা ‘গাছ শাজাহান’ নামে ডাকেন। তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে নিজ গ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত খরচে ৬০ থেকে ৭০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করেছেন।

তার অদম্য ইচ্ছা, চেষ্টা আর একাগ্রতায় কৌড়ি গ্রাম যেন শিল্পীর পটে আঁকা এক অপরূপ চিত্র। সারি সারি বৃক্ষে ভরপুর গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। কৌড়ি গ্রামের আঁকাবাঁকা সরু রাস্তার দু’পাশে ফলজ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষের সমাহার। সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা যায় কৌড়ি গ্রামের।

কৌড়ি গ্রামসহ আশপাশের এলাকার এমন পরিবেশ যেকোনো বয়সের মানুষকে আকৃষ্ট করবে। পুরো এলাকা যেন সবুজের গালিচায় মোড়ানো। দীর্ঘ সময় ধরে তিল তিল করে সবুজের এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বৃক্ষপ্রেমী শাজাহান বিশ্বাস।

বৃক্ষপ্রেমী শাজাহান বিশ্বাসের রোপন করা বৃক্ষ/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

কৌড়ি গ্রামের তুহিন আহমেদ বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখছি শাজাহান কাকা গাছ লাগানো ও রাস্তার উন্নয়নে কাজ করছেন। আমাদের গ্রামের আজকের এই পরিবেশের পেছনে তার অবদান সবচেয়ে বেশি। গাছ থেকে যে আয় হয় তার থেকে তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ড ও রাস্তা-ঘাট উন্নয়নে ব্যয় করেন। একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে আমাদের কৌড়ি গ্রাম সব জায়গায় পরিচিত। অনেক দূর-দূরান্তের মানুষও এ গ্রামকে সহজেই চেনে। 

একই এলাকার আজিম বিশ্বাস বলেন, গাছগুলো অনেক উপকারে আসছে। গাছ আমাদের ছায়া দেয়। মূল্যবান কাঠ পাওয়া যায়। আবার যাদের জমিতে গাছ লাগানো হয়েছে তারাও লাভবান। গাছ রোপণের বিষয়ে তিনি বলেন, কৌড়ি গ্রামের প্রায় সবগুলো গাছই শাজাহান বিশ্বাস নিজ খরচে রোপণ করেছেন। এছাড়া এসব গাছের রক্ষণাবেক্ষণও তিনিই করেন। অনেকেই তো গাছ রোপণ করেন তবে সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগানোর এমন দৃশ্য কোথাও নেই।

ছায়া দেয় বৃক্ষ/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

কৌড়ি গ্রামের এম এম রউফ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক দাউদ হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান বিশ্বাস দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে নিজ খরচে গাছ রোপণ করছেন। এক সময় এই গ্রামের রাস্তার পাশের জায়গাগুলো পতিত ছিল। গ্রামে যে পরিমাণ গাছ রোপণ করা হয়েছে তাতে প্রায় ৬০ হাজার গাছ হবে। দেশের সব গ্রামেই এভাবে গাছ রোপণ করা হলে কৌড়ি গ্রামের মতো সবুজ অরণ্যে ভরে যাবে। শাজাহান ভাইয়ের মতো গাছ রোপণ করলে দেশের সবগুলো গ্রাম সমৃদ্ধ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাইদুর রহমান বাদল নামের একজন বলেন, কৌড়ি গ্রামটি দেখতে খুবই সুন্দর। আমার অনেক ভালো লাগে। এই গ্রামের যেখানে ফল গাছ প্রয়োজন সেখান ফল গাছ, যেখানে কাঠ গাছ প্রয়োজন সেখানে কাঠ গাছ লাগানো হয়েছে। গোটা গ্রামে সারি সারি গাছ লাগানোয় কৌড়ি গ্রামটি দেখতে সুন্দর লাগে। শাজাহান ভাইয়ের মতো সারাদেশে গাছ রোপণ করলে প্রত্যেকটি এলাকাই ফুলে-ফলে ভরে যাবে। 

সোনাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফাতেমা খাতুন বলেন, সামাজিক কাজের মধ্যে অনেক আনন্দ আছে। শাহাজান ভাই নিজ অর্থায়নে আমাদের বিদ্যালয়েও অনেক গাছ রোপণ করেছেন। ২০ বছর আগে আমাদের বিদ্যালয়ে তিনি চার হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। গাছপ্রেমী শাজাহান ভাইয়ের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এই কৌড়ি গ্রামে শাজাহান ভাই যে পরিমাণ গাছ রোপণ করেছেন তাতে অর্থনৈতিকভাবে সবাই স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা পেয়েছে। দেশের প্রতিটি গ্রামে যেন এমন শাজাহান ভাই জন্ম নেয়। তারা যদি সামাজিকভাবে এগিয়ে আসেন তাহলে দেশ অনেক উপকৃত হবে।

অক্সিজেন ও ছায়া ছাড়াও বৃক্ষ বাড়ায় শোভা/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

বৃক্ষপ্রেমী শাজাহান বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে জানান, কৌড়ি গ্রামসহ হরিরামপুর উপজেলার সাধারণ মানুষ গাছ শাজাহান হিসেবেই চেনেন। ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাশের পরে বিদেশ চলে যান তিনি। প্রবাস জীবনে বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চল আর বৃক্ষরোপণ দেখেন। মূলতে সেখান থেকেই বৃক্ষপ্রেমী হয়ে ওঠেন।

পাঁচ বছরের প্রবাস জীবনের ইতি টেনে দেশে চলে আসেন। স্বল্প পরিসরে গড়ে তোলেন নার্সারি। সেখানে বিভিন্ন জাতের চারা গাছ উৎপাদন করে নিজ গ্রামের রাস্তার দু’পাশে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিসে ব্যক্তিগত খরচে গাছ লাগানো শুরু করেন। সেই থেকে শুরু করে বৃক্ষপ্রেমী শাজাহানের গাছ লাগিয়ে কেটে গেছে ৪০ বছর। শরীর সুস্থ থাকলেই উৎফুল্ল মন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গাছ রোপণে। নিজ গ্রামে এ পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার গাছ রোপণ করেছেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ বছর পরে এসব গাছ বিক্রি করলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে।

শাজাহান বিশ্বাস আরও বলেন, বৃক্ষের প্রেমে পড়ে সংসার কারাও ফুরসৎ হয়নি তার। সমাজই তার সংসার। গাছগুলো আমি রোপণ করেছি তবে জমি যার গাছ তার আর প্রতিষ্ঠানের গাছ প্রতিষ্ঠানের। যেদিন এই গাছ টাকা দিবে সেদিন হয়তো আমি থাকবো না। কাজেই গাছের শেয়ার বা মালিকানার দরকার নেই। একজন গবীর বা খেটে খাওয়া মানুষের কাছে গাছ রোপণ করার টাকা নাও থাকতে পারে আর এটাও আমার একটা যাকাত। এ কারণেই নিজস্ব অর্থায়নে গাছ রোপণ করেছি।

তিনি বলেন, নিজের অর্থ দিয়ে গ্রামের অসহায় মানুষের সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। একজন ব্যক্তিকে ১০০ টাকা না দিয়ে তার জমিতে ১০টি গাছ রোপণ করলে ওই ব্যক্তির বেশি উপকার হবে। 

তার মতে, দেশের প্রত্যেক গ্রামের শাজাহানরা যদি পরিকল্পিতভাবে গাছ রোপণসহ সামাজিক কাজে এগিয়ে আসে তাহলে বাংলাদেশ একদিন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে।

তিনি বলেন, আমার মতো দেশের সব শাজাহান তার গ্রামে এভাবে গাছ রোপণ করলে তাহলে ইউরোপ, আমেরিকা আমাদের কাছে কিছুই না। গাছ শুধু গ্রামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি অর্থকরী সম্পদ। উন্নত দেশে আয়তনের অর্ধেকের বেশি বনায়ন থাকে। এই বনায়ন হলো ওই দেশের একটি রিজার্ভ ফান্ড। জীবনের বাকি দিনগুলো গাছ রোপণ করেই কাটিয়ে দিতে চান ষাটোর্ধ এই বৃক্ষপ্রেমী শাজাহান বিশ্বাস।

ওএফ/এইচকে