বোরহান উদ্দিন টিপু

কেঁচোতেই ভাঙতে বসেছিল রাজশাহীর খামারি বোরহান উদ্দিন টিপুর সংসার। বছর ছয়েক আগে দুই ছেলে-মেয়ে, স্বামী এবং সাজানো সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন সাজেদা বেগম। কিন্তু সেই সাজেদা বেগম এখন পড়েছেন কেঁচোর প্রেমে। টিপু-সাজেদা দম্পতির ভাগ্য বদলে দিয়েছে কেঁচো।

রাজশাহী নগরীর হড়গ্রাম এলাকার বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন নগরীর মোল্লাপাড়া এলাকায় নিজস্ব জায়গায় গড়ে তুলেছেন ‘আহমেদ ভার্মি কমপোস্ট’ নামে একটি খামার। এই খামারে এখন কেঁচো রয়েছে দেড় কোটির ওপরে যার বাজার মূল্য চার কোটি টাকা। তাছাড়া সার বিক্রি করে মাসে অন্তত সোয়া দুই লাখ টাকা আয় করছেন এই খামারি।

সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে ঘুরে উদ্যোক্তার কর্মযজ্ঞ চোখে পড়েছে। তিনি জানিয়েছেন, তার বাবা ছিলেন কৃষক। পাঁচ ভাই ও চার বোনের সবাই উচ্চ শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। তিনি চেয়েছিলেন, পড়ালেখা করে চাকরি নয়; ব্যবসা করতে, নিজের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি কিছু মানুষকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে।

এরপর গরুর খামার থেকে শুরু করেন কেঁচো চাষ। কিন্তু শুরুতে স্ত্রী পরিবার কাউকেই পাশে পাননি তিনি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউই তার এই উদ্যোগ মেনে নিতে পারেনি। এখন তারাই উল্টো উৎসাহ দেন।

রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৭৮ সালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন বোরহান উদ্দিন টিপু। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৮১ সালের দিকে তিনি নাম লেখান ঠিকাদারিতে। এরপর ১৯৯০ সালের দিকে ঠিকাদারির পাশাপাশি শুরু করেন আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা। পরের বছর গড়ে তোলেন গরুর খামার। প্রথমে গরু মোটাতাজাকরণ করতেন। পরে দুগ্ধ উৎপাদনে যান।

কমপোস্ট খামার

আর বছর ছয়েক আগে খামারের প্রয়োজনে বসিয়েছেন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। ‘বায়ো স্ল্যারি’ দিয়ে উৎপাদন শুরু করেন ভার্মি কম্পোস্ট সার।  দিনে দিনে খামারের পরিসর বেড়েছে। তার নিজস্ব খামারের গরু দিয়ে এখন আর এই প্রকল্প চলছে না। স্থানীয় খামার থেকে প্রতিদিন দুই টন করে কাঁচা গোবর সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

এই খামারি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসার্ট এলাকার কয়েকজন প্রান্তিক খামারির কাছ থেকে তিনি ২ লাখ টাকার কেঁচো সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আরও কিছু কেঁচো আসে। এখন খামারে ‘অস্ট্রেলিয়ান নাইটকুইন’ ও ‘আফ্রিকান রেডওয়ান’ জাতের প্রায় দেড় কোটি কেঁচো রয়েছে। এ থেকে খামারে প্রতি মাসে ২০ টন সার উৎপাদন হয়।

কেঁচো চাষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে এই খামারি বলেন, খাবার হিসেবে চাড়িতে কাঁচা গোবর দেওয়ার আগে অ্যাসিড এবং গ্যাস দূর করতে হয়। সেই প্রক্রিয়াটিও আছে বায়োগ্যাস দিয়ে। খাবার হিসেবে কেঁচোকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বায়ো স্ল্যারি দেওয়া হয়। গোবর, কলার গাছ, কচুরিপানা, নিমপাতা এবং মেহগনি পাতা এক সঙ্গে ৪০ দিন পঁচাতে হয়। পরে তা ১০ শতাংশ হারে বায়ো স্ল্যারির সঙ্গে মেশানো হয়। তবেই সেটি কেঁচোর উৎকৃষ্ট খাবার হয়ে ওঠে। কেঁচোর খাবার উৎকৃষ্ট হলে কম্পোস্ট সারে অত্যাবশ্যকীয় ১৩টি উপাদান যুক্ত হয়।

এই উদ্যোগের শুরুর গল্পও শুনিয়েছেন টিপু। তিনি বলেন, মূলত গরুর খামার হিসেবেই তিনি এই উদ্যোগ শুরু করেন। যারা খামার দেখাশোনা করেন, তাদের রান্নাবান্নার সমস্যা দূর করতে তিনি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট বসান। বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট থেকেই তিনি ভার্মিতে যাওয়ার পরিকল্পনা নেন। পরে তিনি কৃষি দপ্তরে যোগাযোগ করেন। তারাও তাকে চরমভাবে উৎসাহ দেন। এই থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন এই খামার। আগামী দুই এক বছরের মধ্যে উৎপাদন দ্বিগুণ হলে তার প্রকল্পটি আরও লাভজনক হবে।

বিপণন পরিকল্পনা জানতে চাইলে এই উদ্যোক্তা বলেন, তিনি সার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করেন না। কারণ ব্যবসায়ীরা নিজেদের মুনাফার দিকে তাকাবেন। কম দামে সার কিনে বেশি দামে কৃষকের কাছে বিক্রি করবেন। এই ভাবনা মাথায় রেখে সরাসরি কৃষক এবং বাগানিদের কাছে সার পৌঁছে দিচ্ছেন। এক সময় ফ্রিতে সার পৌঁছে দিয়েছেন। এখন রাজশাহীতে ভার্মি কম্পোস্ট সারের আলাদা বাজার তৈরি করেছেন। তার একার উৎপাদনে এই বাজার ধরে রাখা সম্ভব নয়। নতুন উদ্যোক্তারা সহজেই এ বাজার পেয়ে যাবেন।  

এই কাজ শুরুর আগের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম দিকে তিনি কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন, তখন তার কেঁচো সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রথম বছরে ২ লাখ টাকা দিয়ে কেঁচো এনে অর্ধেক মারা গেল। এরপর তিনি বিষয়টি ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবেই নিই। ইউটিউব ঘেঁটে, বিভিন্ন জনের কাছে, কৃষি বিভাগের কাছে পরামর্শ নিয়ে কাজ চালিয়ে যান। এখন এটি একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তিনি এই কাজে এখনও পুরোপুরি অভিজ্ঞ হতে পারেননি। এ থেকে এখনও তার অনেক শেখার আছে।  

কেঁচো চাষের সংকট জানতে চাইলে এই উদ্যোক্তা বলেন, এই প্রকল্পে সবচেয়ে বড় সংকট কেঁচোর পরিচর্যা। কেঁচো পরিচর্যার কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে। কেঁচোর তাপমাত্রা ঠিক রাখতে হবে, হাউজগুলোর পাশে পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে নয়তো পিঁপড়া, ইঁদুর এবং পাখির আক্রমণ হবে। সঠিক পরিচর্যা পেলে ৯০ দিনে কেঁচোর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। সার ব্যবহারকারীদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি ভার্মি কম্পোস্ট সারের বাণিজ্যিক উৎপাদন এগিয়ে নিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

এসপি