বৃষ্টির অপেক্ষায় থেকে থেকে আষাঢ় শেষ হয়ে গেছে। এখন চলছে শ্রাবণ, তবুও দেখা নেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির। ভরা বর্ষায় অনাবৃষ্টির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন রংপুরের কৃষক আমজাদ হোসেন। আমন আবাদের প্রস্তুতি নিলেও বৃষ্টি না হওয়ায় মরতে বসেছে তার বীজতলা। অর্থাভাবে এই কৃষক আমন আবাদে সম্পূরক সেচও দিতে পারছেন না।

আমজাদ হোসেনের মতোই অবস্থা এখন উত্তরের লাখ লাখ কৃষকের। বৃষ্টি না হওয়ায় আমন আবাদ নিয়ে তারা পড়েছেন অনিশ্চয়তায়।

কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে আমন চাষের চেষ্টা করছেন। কৃষক আব্দুর রাজ্জাক যেমন ধার দেনা করে সেচের পানিতে শুরু করেছেন চাষাবাদ। তার মতো অনেকে বাড়তি খরচের ধকল মেনেই সম্পূরক সেচের (মেশিনের মাধ্যমে ভূ-গর্ভ থেকে পানি উত্তোলন) মাধ্যমে আমন আবাদ শুরু করছেন। তবে টাকার অভাবে এ প্রক্রিয়া মেনে চাষ করা সবার পক্ষে সম্ভব হবে না।

রংপুরের কৃষি বিভাগ ও আবহাওয়া অফিস বলছে, বর্ষাকালে স্মরণকালের সবচেয়ে উষ্ঞ দাবদাহ চলছে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে। গত ২০ দিন ধরে তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠা-নামা করছে। এখনো দেখা নেই বর্ষার, নেই কালো মেঘের ঘনঘটা। প্রখর রোদে চারদিক তপ্ত। এতে উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে; ভরা বর্ষায় দেখা দিয়েছে খরা। প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণকে অশনি সংকেত বলছেন আবহাওয়াবিদরা।

খরা ও অনাবৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাটসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলায় ইস্তিখারা নামাজ আদায় করেছেন হাজার হাজার কৃষকসহ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। নামাজ শেষে অনাবৃষ্টি থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করে হু হু করে কেঁদেছেন তারা। গেল কয়েক দিনে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এলাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলেও কাঙিক্ষত বর্ষণ শুরু হয়নি।

রংপুর সদরের চন্দনপাট ইউনিয়নের চাপরার বিল। যেখানে আষাঢ়-শ্রাবণে থই থই করে পানি। এবার এই বিলের পানি খরতাপে পুড়ে প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার পথে। রেকর্ড ভাঙা দাবদাহে উঁচু জমিগুলোর অবস্থা আরও বেহাল। জমি ফেটে চৌচির। আমনের বীজতলারও সময় শেষ। সেচ দিয়ে রোপণ করলে বাড়তি খরচ হচ্ছে। আবার বিলম্বে আমন লাগালে ফলন হবে কম।

তীব্র রোদ উপেক্ষা করেই তাই এখন চলছে জমি তৈরির কাজ। কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে রোপন। তবে রোদের তীব্রতার চেয়েও বাড়তি খরচের ধকলে পুড়ছেন কৃষক। 

চন্দনপাট ইউনিয়নের শ্যামপুর বাজার এলাকার কৃষক এরশাদ মিয়া বলেন, ‘জীবনে হামার এত্তি চাপরার দোলার পানি শুকায় নাই। কিন্তু এবার রেকর্ড ফেল। বৃষ্টিও নাই, পানিও নাই। আমন যে রোপণ করমো, তার জন্য বাড়তি টাকা ছাড়া উপায় নাই। এ্যালা পানি নেওবার গেইলে দোন প্রতি কমপক্ষে ২ হাজার ৫০০ টাকা লাগোছে।’

একই এলাকার কৃষক মোজাহার আলী বলেন, ‘বৃষ্টির পানি নাই। আবাদ করমো কেমন করি। আকাশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। বর্ষাকালেও বৃষ্টি হওছে না। আর কত দিন অপেক্ষা করমো। বেশি দিন বীজতলা পড়ি থাকলে মরি যাইবে। ওই তকনে মেশিনের পানি দিয়্যা আবাদ করা শুরু করছি। খরচ বেশি হওছে। কিন্তু হামরা তো গরিব মানুষ। চাষাবাদ না করলে খামো কী। আল্লাহ্ যদি সহায় হয়, বৃষ্টি হইলে খরচ কমবে।’

মূলত আষাঢ়ের বৃষ্টিই ভরসা আমন চাষিদের। তবে এবার আষাঢ় শেষে শ্রাবণেরও সাতদিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বৃষ্টি নেই। তাই সেচের উপরই এখন নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন কৃষকেরা। সেচের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে শ্রমিকের বাড়তি মজুরি।

২৫ জুলাইয়ের আগে আমন লাগাতে না পারলে ফলন কাঙ্ক্ষিত হবে না। তাই বদরগঞ্জের নান্দিয়ার বিলের কৃষক আব্দুস সালাম গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচে আবাদ করছেন। এতে প্রতি একরে তার বাড়তি খরচ পড়ছে হাজার টাকার ওপরে। এই কৃষক বলেন, ‘বৃষ্টির পানি না থাকার কারণে মেশিন লাগাইছি। অন্যরাও একইভাবে পানি নিতেছে। তেল, পানি ও মেশিনের ভাড়া তো আছেই। এখন বাড়তি খরচ এক হাজারের বেশি। খাবার জন্য হলেও তো খরচ করে আবাদ করতে হবে। তা ছাড়া আমাদের উপায় নাই।

আবহাওয়া অফিস বলছে, জুলাই মাসে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় ৪৫৩ মিলিমিটার। কিন্তু গেল ২০ দিনে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার। এই সময়টাতে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩২-৩৩  ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। তবে গেল ২০ দিনে রংপুর বিভাগে ২৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমের এ সময়টাতে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি তাপমাত্রা বাড়লেও তা ২ থেকে ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হওয়ার কথা নয়। তবে এবার এর ব্যতিক্রম ঘটেছে।

রংপুর বিভাগে ২০২০ সালে জুলাইয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৮০৪ মিলিমিটার। তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩৪ দশমিক শূন্য ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর ২০২১ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১৯৬ মিলিমিটার, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৪ এবং সর্বনিম্ন ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছর চলতি মাসে এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার । তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বনিম্ন ২৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টানা ২০ দিন ধরে স্বাভাবিকের থেকে তাপমাত্রা বেশি ছিল ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। 

আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন উত্তরের কৃষির জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম কামরুল হাসান। তিনি বলেন, স্বাভাবিক বৃষ্টি না হলে আমন চাষে তিন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষক। প্রথমত সেচে বাড়তি খরচ, দ্বিতীয়ত ক্ষেতে আগাছা, রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যায় এবং তৃতীয়ত উৎপাদিত ধানে ভালো মানের চাল পাওয়া যাবে না।

এদিকে কৃষি বিভাগের দাবি, এই অঞ্চলে ৯ হাজার গভীর ও চার লাখ অগভীর নলকূপ রয়েছে। সম্ভাব্য খরার শঙ্কায় সেচ নালা নষ্ট না করার পরামর্শ ছিল কৃষকদের প্রতি। যথা সময়ে আমনের চারা রোপণ করা না হলে কাঙ্ক্ষিত ফলন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে কারণেই আমন আবাদে কৃষকদের সম্পূরক সেচের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সে কারণেই কৃষকদের বন্যা ও খরা-সহিষ্ণু ধান আবাদেও উৎসাহিত করা হয়েছে।

এবার রংপুরসহ উত্তরের ১৬ জেলার চারটি কৃষি জোনে প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে এখন পর্যন্ত এর মধ্যে আবাদ হয়েছে মাত্র এক লাখ হেক্টরে। সেটিও করতে হয়েছে সম্পূরক সেচ দিয়ে। বাকি জমিগুলো সম্পূরক শেষ দিয়ে আবাদ করতে গেলে কৃষকের এবার বাড়তি খরচ হবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। আগামী কিছু দিনের মধ্যে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে এই অংক আরও বাড়বে।

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপ-পরিচালক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ধানের আবাদ যাতে পিছিয়ে না যায়, এজন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বোরো ধানের ক্ষেত্রে কৃষক শতভাগ সেচ-নির্ভর। কিন্তু আমনের বেলায় বৃষ্টির পানির ওপরেই বেশি নির্ভরশীল তারা। এবার যেহেতু পরিস্থিতি ভিন্ন, তাই সম্পূরক সেচের দিকেই অনেকে ঝুঁকছেন। এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র চার থেকে সাড়ে চার ভাগ আমন রোপণ হয়েছে। 

আরএআর/জেএস