‘বর্ষায় যখন খাল-বিলের পানি বাড়ে, তখন বিক্রেতারা দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার ক্রেতা বেশি দেখলেও দাম বাড়িয়ে দেয়। বলতে পারেন, পানি বাড়লে নৌকার দাম বাড়ে, পানি কমলে দাম কমে।’

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী আটঘর নৌকার হাটের ক্রেতা আব্দুল মালেকের মন্তব্য এটি।

শুক্রবার (২২ জুলাই) নৌকা কিনতে এসে গলদঘর্ম তিনি। অপ্রত্যাশিতভাবে বেশি দাম চাইছেন বিক্রেতারা। শুধু মালেক নন, তার মতো এমন কয়েকশ ক্রেতা কোনো সুবিধা করতে পারেননি।

তবে বিক্রেতারা দাবি করেছেন, সারা বছর নৌকার হাট জমে না। বর্ষার তিন মাসের মধ্যে শ্রাবণ মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে আটঘর-কুড়িয়ানা ও ভিমরুলীর পেয়ারা-বাগানে নৌকার প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি হয়। এজন্য ব্যবসা এই মাসেই করে নিতে হয়।

সরেজমিনে আটঘর বাজারে দেখা গেছে, নদীতে ও মূল সড়কের দুই পাশে প্রায় এক কিলোমিটার স্থানজুড়ে সারি সারি নতুন নৌকা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ ক্রেতার সঙ্গে বচসা করছেন, কেউ নতুন নৌকা ভালোভাবে দেখিয়ে ক্রেতা রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। আবার কেউ বিক্রি করা নৌকার ইজারা দিতে ছুটছেন ইজারাদারের ঘরে। নতুন নৌকা পরিবহন করে নিয়ে আসছেন অনেকে, অনেকে কেনা নৌকা নিয়ে ফিরছেন গন্তব্যে। পুরো এলাকাজুড়ে কর্মব্যস্ততা। কথা বলার ফুরসত নেই কারোরই।

নৌকার কারিগর কবির নিজের বানানো দুটি নৌকা নিয়ে এসেছেন হাটে। যদিও ফি সপ্তাহে তিনি তিনটি করে নৌকা বানাতে পারেন। আর বানানো শেষ হলে এই হাটেই নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের নৌকা তৈরি করি। এর মধ্যে রয়েছে টালাই, গলুই, পেনিস ইত্যাদি। আড়াই হাজার টাকা থেকে শুরু করে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত এসব নৌকা বিক্রি করি।

তিনি আরও বলেন, আষাঢ়-শ্রবাণ মাসে এই মৌসুমে পানি বৃদ্ধি পায়। অনেকে মাছ শিকারে বেড় হয় খালে-বিলে। অনেকে পেয়ারা-বাগানে নিজের জন্য আবার পর্যটকদের জন্যও কিনে। এ জন্য এই সময়ে চাহিদা ভালো থাকে নৌকার। দামও বাড়ানো হয় এই সময়কে লক্ষ্য করে।

ঝালকাঠি জেলার নথুল্লাবাদ ইউনিয়ন থেকে এসেছেন ক্রেতা তৈয়ব আলী। দু-চার বছর নয়, দেশ স্বাধীনের আগেই তিনি এই হাট থেকে নৌকা কেনেন। তিনি বলেন, এই হাটে বড় নৌকার কোনো ক্রেতা নেই। দুই থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত নৌকা এখন পাওয় যায়। সাধারণত ডিঙি ও পেনিস নৌকা পাওয়া যায়। এগুলো গ্রামগঞ্জের খালে-বিলে চালায় গ্রামবাসী। ছোট ছোট প্রয়োজন মেটাতে এই নৌকা।

৩০ বছর ধরে নৌকার ব্যবসা করেন আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, আটঘরের নৌকার হাট এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাট। নৌকার ব্যবসা এখন মোটামুটি হচ্ছে। বর্ষায় জমে উঠেছে। ক্রেতাও আসতে শুরু করেছে।

ব্যবসায়ী ফারুক বলেন, আজ ২৫টি নৌকা নিয়ে এসেছি। এখন পর্যন্ত চারটি বিক্রি করেছি। সব নৌকাই বিক্রি হয়ে যাবে।

জমজমাট বইঠার হাটও
নৌকার হাট জমজমাট হয়ে ওঠার পাশাপাশি বইঠার হাটও জমে উঠেছে। আটঘরের নৌকার হাটের মধ্যেই অস্থায়ীভাবে জমে এই হাট। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ দিয়ে বইঠা তৈরি করে সাজিয়ে রাখেন। গাছ ও আকৃতির প্রকারভেদে এসব বইঠার দাম নির্ধারিত হয়।

স্বরূপকাঠি উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের চামিয়া একতা বাজারের বাসিন্দা আব্দুল গাফফার বইঠার ব্যবসা করেন আটঘর হাটে। প্রতি শুক্রবার যা আয় হয়, তাতে পুরো সপ্তাহ তার চলে যায়। তিনি জানান, নৌকার বিক্রির ওপর নির্ভর করে বইঠার চাহিদা। নৌকার বিক্রি বাড়লে বইঠারও ক্রেতা বাড়ে। আগে সুন্দরবনের সুন্দরী কাঠের বইঠা কিনে এনে বিক্রি করতাম।

এখন তো সুন্দরী কাঠ পাওয়া যায় না। এ জন্য বলদিয়া ইউনিয়নে কারিগররা বইঠা বানায়। সেগুলো পাইকারি কিনে এনে খুচরা বিক্রি করি এই হাটে। দেড় শ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বইঠার দাম আছে।

বইঠার কারিগর সেলিম বলেন, দিনে আমরা ৫০টি করে বইঠা তৈরি করতে পারি। আমরা কোনো ফড়িয়ার কাছে বিক্রি না করে সরাসরি হাটে তুলে বইঠা বিক্রি করি। ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বইঠার দাম রয়েছে।

অভিযোগ ইজারাদারের বিরুদ্ধে
নৌকার হাট জমজমাট হলে হাটের ইজারাদার বিভিন্ন অজুহাতে বেশি টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ ক্রেতা-বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র পরিবহনশ্রমিকদের। এর মধ্যে এক এক হাটে নৌকা বিক্রি হলে পৃথক খাজনা আদায় করেন। বিক্রি হওয়া নৌকা গাড়িতে করে নিতে হলে গাড়িচালককে টাকা দিতে হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শফিকুল ইসলাম নামের এক গাড়িচালক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমি এখান থেকে নৌকা আনা-নেওয়া করি। এখন ইজারাদার নতুন করে নিয়ম করেছেন বিক্রি হওয়া নৌকা গাড়িতে তুললেই গাড়িচালকদের ২০ টাকা করে দিতে হবে।

একই অভিযোগ করেন আরেক গাড়িচালক বলেন, সম্পূর্ণ অনুচিতভাবে ইজারাদার আমাদের কাছ থেকে নৌকাপ্রতি ২০ টাকা আদায় করছেন। তারা হাটে নিরাপত্তাকর্মী রেখেছেন। তার বেতন দিতে এভাবে টাকা আদায় করছেন। তারা লোক রেখেছেন, সেই টাকা গাড়িওয়ালারা দেবেন কেন?

এ নিয়ে আটঘরের ইজারাদার আব্দুর রহিম বলেন, বর্ষার মৌসুম কেন্দ্র করেই আমাদের এ হাটটি জমজমাট হয়। মূল ব্যবসা বর্ষার তিন মাস। তবে নৌকা, মাছ শিকারের উপকরণ অল্প অল্প করে হলেও ওঠে পাঁচ মাস। বছরের অন্য সময় সবজি, তরকারির ওপর নির্ভর করে হাট চলে। তিনি আরও বলেন, এখানে আমাদের বসার জন্য একটি স্টল খুবই জরুরি। বর্ষার সময় ক্রেতা-বিক্রেতারা কোথাও বসতে পারেন না। ভিজেই হাট করতে হয় তাদের।

অভিযোগ বিষয়ে আব্দুর রহিম বলেন, হাট থেকে নৌকা চুরি হয়। এ জন্য দেখভাল করতে লোক রেখেছি। সেই লোকের সম্মানী দিতে ২০ টাকা করে নিচ্ছি। এ ছাড়া আর কারও কাছ থেকে বেশি কোনো টাকা নিই না।

আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার বলেন, আটঘর ও কুড়িয়ানা বাজার ঘিরে আমাদের বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। মাঝখানে করোনার কারণে তাতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। তবে শিগিরই কাজ শুরু করব।

তিনি আরও বলেন, ক্রেতা-বিক্রেতাদের বসার জন্য দুটি শেড নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া পর্যটক যারা আসেন, তাদের জন্য শেড নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি পর্যটকদের যেন কেউ হয়রানি না করেন, সে জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে বলে পরিকল্পনা রয়েছে।

এনএ