গ্রামের প্রায় সবগুলো টিউবওয়েলে লাল চিহ্ন দেওয়া। গ্রামের বাসিন্দারাও জানেন এই পানি তাদের জন্য নিরাপদ নয়। আর নিরাপদ পানি পেতে যেতে হবে পাশের গ্রামে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। তাই বাধ্য হয়েই পান করছেন আর্সেনিকযুক্ত পানি। আর এতেই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গ্রামটিতে। 

জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া গ্রামের প্রায় ৫৫টি পরিবার এখন আর্সেনিক আতঙ্কে দিন পার করছেন। গত কয়েকদিন থেকে বাসিন্দাদের দেহে আর্সেনিকের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। গ্রামের কয়েকজন ইতোমধ্যে ভয়াবহ আর্সেনিকের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নিজেদের স্থাপিত সাবমার্সেবল পাম্প ও টিউবওয়েলের পানি ব্যবহারে আর্সেনিকে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।

ইতোমধ্যে গ্রামের মানুষের হাত-পায়ে গুটিসহ সারা শরীরে কালো তিল দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শরীরে কালো কালো দাগ, হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, শুধুমাত্র হাত-পায়ে ঘা নয়, সর্দি, জ্বর, শ্বাসকষ্টে ভুগছেন।জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, এই গ্রামের এরই মধ্যে ৪০ জন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন। 

বেতবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর ও তার স্ত্রী আলেপনূর, আকলিমা, আঁখি, নজরুল, মাসুদ, সাইদুল, আশরাফুলসহ আরও অনেকের হাতে-পায়ে কালো কালো দাগ হচ্ছে। আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানির অভাবে অনেকটা নিরুপায় হয়ে জেনেশুনেই তারা বিষপান করছেন।

গ্রামের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মো. জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আলেপনুর বেগমের। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, প্রায় দুই মাস থেকে হাত, পা ও শরীরে ফোটা ফোটা দাগ হতে শুরু করে। পরে ঘা হয়ে গেছে। এখন নিজে নিজে হাঁটা চলাফেরা কিছুই করতে পারি না। শুয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ডাক্তারের কাছে গেলেও তারা বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে বলছেন। কিন্তু কীভাবে তা করব? কারণ আমারও স্বামীও অসুস্থ। চিকিৎসাব্যয়ই বহন করতে পারছি না। আমার জীবনটাই শেষ করে দিল এই আর্সেনিক। 

হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে জিয়ারুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ বেগমের। তিনি বলেন, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে টিউবওয়েল আছে। কিন্তু একটি টিউবওয়েলেও নিরাপদ পানি নেই। তাই বাধ্য হয়েই সবাই আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করি। আমরা গত ১৫ বছর ধরে এই পানি পান করে আসছি। এতদিন তেমন কোনা শারীরিক সমস্যা দেখা না গেলেও গত কয়েক বছর থেকে হাতে পায়ে ফোঁসকা ও ঘা দেখা দিয়েছে। জ্বর-সর্দি আসলে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। 

খাদেমুল ইসলামের স্ত্রী শিউলী বেগম বলেন, ভোটের সময় সবাই আসে আর প্রতিশ্রুতি দেয় আর্সেনিকমুক্ত পানি দেওয়ার। কিন্তু তা আর দেয় না। এভাবেই ১৬ বছর ধরে এখানে বসবাস করছি। আমাদের কেউ দেখে না। সরকার দেশের নাগরিকদের জন্য এত কিছু করছে। তাহলে এতদিন ধরে ৫০-৫৫টি পরিবারের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা কেন হয় না? বেতবাড়িয়া গ্রামে আমরা দ্রুত নিরাপদ পানির ব্যবস্থা চাই। 

এই গ্রামের একটি পরিবার প্রায় দেড় কিলোমিটার দূর থেকে পানি নিয়ে এসে ব্যবহার করে। সেই পরিবারের এক সদস্য স্কুলছাত্র মো. নাইম ঢাকা পোস্টকে বলে, আমাদের বাড়িতেও টিউবওয়েল আছে। সেখানে লাল দাগ দেওয়া। তাই সেই পানি খেতে পারি না। দূর থেকে প্রতিদিন সাইকেলে করে পানি নিয়ে এসে পান করি। গ্রামের অনেকেই আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাই দ্রুত নিরাপদ পানির ব্যবস্থা প্রয়োজন।

গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহাব বলেন, এই পানি পানের ফলে হাত-পাতে ঘা হচ্ছে। প্রতিবেশীরা এসব দেখে তিরস্কার করছে। নিজেদের খুবই অসহায় মনে হচ্ছে। জেনেশুনে বিষপান করে নিজেদের জীবন নষ্ট করেছি। সবচেয়ে চিন্তায় আছি, ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে। তাদের কী হবে? 

বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আতাউল হক কমল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চার মাস হলো দায়িত্ব পেয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পরই বেতবাড়িয়া গ্রামের আর্সেনিকের ভয়াবহ অবস্থার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এসব পরিবারের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এমনকি নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। 

সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জন পলাশ হাঁসদা জানান, সদর উপজেলার বেতবাড়িয়া গ্রামের বেশ কিছু মানুষের মধ্যে আর্সেনিকের নমুনা ব্যাপকভাবে পাওয়া গেছে। আমরা সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে প্রতি বছর ২৬টি জলমোটর দিয়ে থাকি, যাতে মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে। টিউবওয়েল বা মোটরের পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ০.০৫ মিলি গ্রাম পার লিটার। এর বেশি হলে পানি খাওয়া বন্ধ করতে হবে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার সরকার জানান, সম্প্রতি ওই গ্রামের ২৯টি টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টিতেই আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যা ভয়াবহ মাত্রায় পাওয়া গেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার অংশ হিসেবে দুটি নিরাপদ পানির উৎসের ব্যবস্থা করা হবে। এর মধ্যে একটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মধ্যমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে বেতবাড়িয়া গ্রাম থেকে প্রায় ৬০০ মিটার দূরে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করে পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে সেই গ্রামে ৬-৭ টি জায়গায় পুরো গ্রামের জন্য পানির সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হবে। এতেও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না করা গেলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফফাত জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেতবাড়িয়া গ্রামের অধিকাংশ মানুষের আর্সেনিক আক্রান্তের খবর শুনে নিজে সরেজমিন পরিদর্শন করেছি এবং আক্রান্ত পরিবারগুলোর লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাৎক্ষণিকভাবে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এমনকি জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বেতবাড়িয়া গ্রামে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

জাহাঙ্গীর আলম/এসপি