বিলাইছড়ি ধুপপানি ঝরনা

বলা হয়ে থাকে মানুষ এই প্রকৃতিরই সন্তান। প্রকৃতির কোলে জন্ম নিয়ে, প্রকৃতির লালন-পালনে বেড়ে উঠি আমরা। আর একসময় তার বুকেই বিলীন হয়ে যাই। যারা ‘মাদার নেচার’ কে ভালোবাসেন তারা সর্বদা চেষ্টা করেন প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে। দীর্ঘ স্কুল শেষে ছোট্ট সন্তান যেমন মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিংবা কর্মব্যস্ত দিন শেষে চাকুরে ছেলে যেমন ঘরে ঢুকেই মাকে খুঁজে, তেমনি প্রকৃতি প্রেমিকরা সময়-সুযোগে ছুটে যায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে। তেমনি এক স্বর্গীয় প্রাকৃতিক সৃষ্টির নাম ‘বিলাইছড়ি ধুপপানি ঝরনা’।

বিলাইছড়ি রাঙামাটি পার্বত্য জেলার একটি উপজেলা। চাকমা ভাষায় বিলাই মানে বিড়াল আর ছড়ি মানে পাহাড় থেকে প্রবাহিত ঝরনা বা ছড়া। বিলাইছড়ি নামকরণের পেছনে এলাকাতে একটি গল্প প্রচলিত আছে। বিলাইছড়ি যখন গহিন অরণ্য ছিল, লোকবসতি খুবই কম ছিল; তখন একদিন একদল চাকমা কাঠুরে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে বড় এক বনবিড়ালের মুখোমুখি হয়েছিল। বনবিড়াল তাদের দেখে আক্রমণ করে বসে। ধস্তাধস্তি শেষে কাঠুরের দল বনবিড়ালটিকে মেরে ফেলে এবং সেটিকে মোটা লাঠিতে ঝুলিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। বনবিড়ালের কল্যাণেই ‘বিলাই’ শব্দটি বিলাইছড়ি উপজেলার নামকরণে জুড়ে গেছে।

রাঙামাটি থেকে বিলাইছড়ির দূরত্ব প্রায় ৪৮কিলোমিটার। যাতায়তের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। প্রতিদিন সকালে একটি এবং বিকেলে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা বিলাইছড়ির উদ্দেশে রাঙামাটি থেকে ছেড়ে যায়। এ ছাড়া রিজার্ভ বোট নিয়েও যাওয়া যায়। বিলাইছড়িতে থাকার জন্য মোটামুটি মানের কিছু আবাসিক হোটেল আছে।

বিলাইছড়ি থেকে আরও দু’ঘণ্টার পাহাড়ি ঢলের নদী পার হয়ে যেতে হবে উলুছড়ি পর্যন্ত। উলুছড়ি থেকে নৌকা করে পাহাড়ি ঢলের নদী পার হয়ে যেতে হবে। এরপর আড়াই-তিন ঘণ্টার হাঁটাপথ। উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে ধুপপানি পাড়ায়। এই ধুপপানি পাড়ার ২০০ মিটার নিচেই রয়েছে প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি ধুপপানি জলপ্রপাত।

 ধুপপানি ঝরনায় যাওয়ার পথে পাহাড়িদের বসতি

ঝরনার জল স্বচ্ছ এবং অনেক উঁচু থেকে নিচে পড়ার কারণে পানির রঙ সাদা দেখায় তাই এর নামকরণ হয়েছে ধুপপানি। সমতল থেকে এর উচ্চতা ১৫০ মিটার। পাহাড়ি বন-জঙ্গলপূর্ণ এলাকা হওয়ার কারণে ঝরনা এলাকায় হরিণ, বুনো শুকর, বনবিড়াল, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ বিচরণ করে। ঝরনার পানি পড়ার শব্দ দুই কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়, যা বর্ষাকালে আরও বৃদ্ধি পায়।

২০০০ সালের দিকে ধুপপানি ঝরনা আবিষ্কার করা হয়। এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এই ঝরনার নিচে ধ্যান শুরু করেন। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর স্থানীয় লোকজন তাকে সেখানে দেখতে পান এবং তাকে খাবার দেওয়ার উদ্দেশে ঝরনায় যাতায়ত শুরু করেন। আর এভাবেই ঝরনাটি জনসন্মুখে পরিচিতি লাভ করে। দিন দিন ঝরনায় পর্যটক সমাগম বেড়েই চলেছে।

ধুপপানি ঝরনায় যেতে হলে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। পার্বত্য অঞ্চল হওয়ার কারণে ধুপপানি ঝরনায় যাওয়ার আগে সেনাবাহিনী ক্যাম্পে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিবন্ধন করে নিতে হয়। গাইডছাড়া গেলে পথ হারিয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে, তাই স্থানীয় গাইড নেওয়া ভালো। সাথে শুকনো খাবার, পানি এসব রাখতে হবে। ট্র্যাকিং এর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। আর মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য কয়েল বা মশার ওষুধ বাধ্যতামূলক।

দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিয়ে আপনি যখন ঝরনায় পৌঁছাবেন, আপনার সকল ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যাবে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকবেন প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টিকে। ঝরনার বিশালতার কাছে নিজেকে সপে দিয়ে বিশ্রাম দিতে পারবেন মনকে। ঝরনার পানির শীতল স্পর্শ ধুয়ে মুছে দেবে সকল নাগরিক ব্যস্ততা আর শহুরে কোলাহল।

এমএসআর