রাজবাড়ীতে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না নিয়েও শতাধিক কৃষক ঋণখেলাপির লাল নোটিশ পেয়েছেন। হঠাৎ করেই ঋণখেলাপির এমন নোটিশ পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের ওই কৃষকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূল ঘটনা ২০১৫ সালের। একটি প্রতারক চক্র ও ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে ঘটনাটি ঘটে। তারা কৃষকদের নামে ঋণ তুলে নিজেরাই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। যাদের নামে ঋণ তোলা হয়েছে, তারা কখনো ঋণের জন্য আবেদন করেননি। ব্যাংকেও যাননি। কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন মাঠকর্মী রেজাউলের সঙ্গে একটি প্রতারক চক্র সমন্বয় করে কিছু কৃষকের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাল ওয়ারিশ সনদ তুলে কৃষকদের নামে ঋণ তুলে নিজেরাই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। অথচ যাদের ঋণ পাওয়ার কথা তারা পাননি। আবার জায়গা-জমি নেই এমন অনেকে ঋণ পেয়েছেন। এ ঘটনার দীর্ঘ সাত বছর পর ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহীতাদের খেলাপির নোটিশ দেওয়া হয়েছে। 

ঋণখেলাপির নোটিশ পেয়েছেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মন্ডল বাড়ির ছেলে ইউসুফ মন্ডল, ছলিম মন্ডল ও আজিম মন্ডল। তারা আপন তিন ভাই। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তারা ব্যাংক থেকে কখনো কোনো ঋণ নেননি। অথচ মাস ছয়েক আগে তিন ভাইয়ের নামে কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা থেকে ঋণখেলাপির লাল নোটিশ আসে।

সেখানে বলা হয়েছে, তারা ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ঋণ নেওয়ার পর থেকেই তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করেননি। যা সুদ-আসলে এখন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। অথচ কখনো ঋণের জন্য আবেদনতে দূরের কথা ব্যাংকেও জাননি তারা। ফলে ব্যাংক থেকে বাড়িতে আসা ঋণখেলাপির চিঠি পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

শুধু এই তিন ভাই নন, খানগঞ্জ গোবিন্দপুর এলাকার বারেক শেখ, লতিফ শেখ, রহিমসহ অনেক কৃষকই পেয়েছেন কৃষি ব্যাংকের ঋণখেলাপির লাল নোটিশ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখায় কর্মরত তৎকালীন মাঠকর্মী রেজাউলসহ তাদের গ্রামের কয়েকজন প্রতারক চক্র জালিয়াতি করে স্থানীয় কৃষকদের নামে ঋণ তুলে তাদের ফাঁসিয়েছেন।

এ ব্যাপারে কথা হয় ঋণখেলাপির নোটিশ পাওয়া ভুক্তভোগী তিন ভাই আজম মন্ডল, ইউসুফ মন্ডল ও সলিম মন্ডলের সঙ্গে। তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এ পর্যন্ত কখনো ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু হঠাৎ করেই মাস ছয়েক আগে কৃষি ব্যাংকের রাজবাড়ী শাখা থেকে কয়েকজন এসে আমাদের তিন ভাইকে তিনটি ঋণখেলাপির লাল নোটিশ দিয়ে যায়। আমরা নাকি ২০১৫ সালে ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। যা সাত বছর পর সুদে-আসলে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা হয়েছে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে এ টাকা পরিশোধ না করলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও মালামাল ক্রোকের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পরে আমরা তিন ভাই ব্যাংকে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করি এবং নথি খুঁজে দেখি ঋণের জন্য তাদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করা হলেও ছবি ব্যবহার করা হয়েছে অন্য মানুষের। আবার ব্যাংকে যে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়া হয়েছে, সেটিতে তাদের নাম-ঠিকানা থাকলেও আসল জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর আর জন্ম তারিখ ঠিক নেই। পরে বিষয়টি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবগত করলে তারা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু দীর্ঘ ৬-৭ মাস পার হলেও বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।

ঋণখেলাপির নোটিশ পাওয়া আরেক ভুক্তভোগী বারেক শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার বয়স হয়ে গেছে, তাই কৃষিকাজ অনেক আগেই বাদ দিছি। এহন ছেলে কৃষি কাজ করে। আমরা বাপ-বেটা কখনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিই নাই। আর রাজবাড়ীর কোথায় কৃষি ব্যাংক, সেটিও আমি জানি না। কখনো ব্যাংকে যাইনি। অথচ চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, আমার ছেলের কাছে ব্যাংক ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা পায়।’

বারেক শেখের ছেলে লতিফ শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, লাল নোটিশ পাওয়ার পর খোঁজ নিতে আমরা ব্যাংকে যায়। পরে দেখি আমাদের নাম করে ঋণ নিয়েছে সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মনছের শেখের ছেলে মো. শাহিন খান। তৎকালীন কৃষি ব্যাংকের মাঠকর্মী রেজাউলের মাধ্যমেই এমন প্রতারণা করে তারা টাকা তুলেছে।

এ ব্যাপারে শাহিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে বেলগাছি রেলস্টেশন এলালায় গিয়ে মিরাজ নামে একজনকে খুঁজে পাওয়া যায়। তার বাড়িও সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাড়ি ছাড়া চাষাবাদের কোনো জমি নেই। ২০১৫ সালের দিকে বেলগাছি বাজারে কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন মাঠকর্মী রেজাউল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তখন রেজাউল কথায় কথায় বলে আপনাকে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিব। তবে এর মধ্যে থেকে আমাকেও ভাগ দিতে হবে। পরে রেজাউল নিজেই জমির জাল কাগজপত্র বানিয়ে ব্যাংক থেকে আমার নামে ৮০ হাজার টাকা ঋণ তোলেন। পরে রেজাউল হক ৫০ হাজার টাকা রেখে আমাকে ৩০ হাজার টাকা দেন। এরপর কিছু দিন রেজাউল আমার কাছে ফোনে ঋণের টাকা চান। আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি ঋণ ব্যাংক থেকে নিয়েছি, ব্যাংকে টাকা দেব। আপনার কাছে দেব না।

তিনি আরও বলেন, আমি ব্যাংকের কোনো নোটিশও পাইনি, টাকাও দেইনি। আমাদের এলাকায় কৃষি ব্যাংকে থেকে এমন ঋণ রেজাউল হকই করে দিয়েছেন, সেখান থেকে টাকার একটি অংশ তিনিই নিয়েছেন।

অভিযুক্ত রেজাউল হক বর্তমানে কৃষি ব্যাংক শরীয়তপুর আঞ্চলিক অফিসে কর্মরত। তার সঙ্গে কথা বলতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে কথা হয় খানগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আতাহার হোসেন তকদিরের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দীর্ঘ ১১ বছর এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম। আমি চেয়ারম্যান থাকাকালীনও গোবিন্দপুর ও হরিহরপুর এলাকার বেশ কয়েকজন কৃষক ঋণখেলাপির লাল নোটিশ পায়। পরে তারা আমার কাছে এসে বলে তারা কখনো ব্যাংক থেকে ঋণের জন্য আবেদনও করেনি। পরে আমি তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে দেখি আমার সই, ইউনিয়নের প্যাড জাল করে ভুয়া ওয়ারিশনামা বানিয়ে ঋণ তোলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এ রকম শতাধিক কৃষকের নামে ঋণখেলাপির নোটিশ এসেছে। স্থানীয় কিছু প্রতারক চক্র ও তৎকালীন কৃষি ব্যাংকের মাঠকর্মী রেজাউল প্রকৃত কৃষকদের নামে টাকা তুলে নিজেরাই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। এ ধরনের প্রতারক চক্রের কারণে প্রকৃত কৃষকরা ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি এ ধরনের প্রতারক চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার ব্যবস্থাপক মো. মোতাহার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ঋণগুলো ২০১৫ সালে বিতরণ করা। আর আমি রাজবাড়ীতে যোগদান করেছি পাঁচ মাস হলো। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সে এখন শরীয়তপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত। তবে এই ঋণখেলাপির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করেছে। ঋণের কাগজপত্র তাদের কাছেই আছে। তাই আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।

এ বিষয়ে শরীয়তপুর কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক (এজিএম) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজবাড়ী কৃষি ব্যাংক শাখায় ঋণ প্রদানে অনিয়মের অভিযোগে রেজাউল হকের বিরুদ্ধে গত ২৭ জুলাই নোটিশ পাওয়ার পর তাকে  ওইদিন থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মীর সামসুজ্জামান/আরএআর