রংপুরের পীরগঞ্জে খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত এখনো ফাইলবন্দি। ১৬ বছর আগে ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে এখানকার কয়লা সংক্রান্ত সমীক্ষা রিপোর্ট বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো অধিদপ্তর, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলাসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত আলো পড়েনি লালফিতায় বন্দি সেই ফাইলে। আর কত বছর পর খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি মিলবে, নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ।

স্থানীয়রা বলছেন, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির মতো রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার খালাশপীরের মদনখালি কয়লাখনি দেশের মূল্যবান সম্পদ। এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সযোগ সৃষ্টি হবে, কমবে বেকারত্ব। এখানকার কয়লা দিয়ে দেশের ৫০ বছরের চাহিদা পূরণ হবে। একই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব হবে।

বিপুল সম্ভাবনার এই কয়লাখনি ঘিরে এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন পীরগঞ্জসহ রংপুর অঞ্চলের মানুষ। বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট জ্বালানি সংকট ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে যখন পরিকল্পনার বিভিন্ন ছক আঁকছেন দেশ-বিদেশের মসনদে থাকা সরকারপ্রধানরা, ঠিক তখন আবারও খালাশপীরের মদনখালি কয়লাখনি নিয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এই খনির বাড়তি কয়লা রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের বিপর্যয় ঠেকাতে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখবে এই খনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ হলেও দীর্ঘদিন ধরে কয়লা উত্তোলনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে বাংলাদেশ ব্যুরো অব মিনারেল ডেভেলপমেন্ট হোসাফ ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় খনি থেকে কয়লা উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ২০০৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর পীরগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালাশপীর খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ সময় আশান্বিত হয়ে উঠেছিলেন পীরগঞ্জবাসী।

এদিকে বিগত তত্ববধায়ক সরকারের সময় খনিজ উন্নয়ন অধিদপ্তরকে সমীক্ষা প্রতিবেদনটি মূল্যায়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে পেট্রোবাংলার হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মাধ্যমে আইএমসিএল নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় হোসাফের জমা দেওয়া স্টাডি রিপোর্টটি মুল্যায়ন করার জন্য। আইএমসিএল এটির মুল্যায়ন কাজ শেষ করে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে জমা দেয়। এতে হোসাফের জমা দেওয়া ফেসিবিলিটি রিপোর্ট যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে আরও কিছু কাজ করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

জানা যায়, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জাতীয় কয়লানীতি প্রণয়ন কমিটির ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল খালাশপীর কয়লাখনি পরিদর্শন করে খনির সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে সন্তোষ প্রকাশ করে উত্তোলন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছিল।

২০০৬ সালে সরকারের কাছে খনির সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ১০ বছর পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ জাহাঙ্গীর আলম এবং হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন মদনখালি খনি এলাকা পরিদর্শন করেন। ওই সময় কয়লাখনির পরিদর্শন এলাকায় হাজারো মানুষ একত্রিত হয়ে কয়লা উত্তোলনের দাবি জানিয়েছিলেন।

সেদিন পরিদর্শনে আসা হোসাফ গ্রপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছিলেন, পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা খনি সমীক্ষার প্রতিবেদন ২০০৬ সালে সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। সরকার কয়লানীতি চূড়ান্ত করলে এ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

কয়লাখনি প্রকল্প সূত্র জানায়, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে মাগুরা গ্রামে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (জিএসবি) পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ওই খনির অবস্থান নির্ণয় করা হয়। এর ৩০ বছর পর ১৯৮৯-১৯৯০ সালে জিএসবি ২৫ বর্গকিলোমিটার খনি এলাকায় প্রাথমিকভাবে ৪টি কূপ খনন করে ৩টিতে ২৮৪ মিটার থেকে ৪৮০ মিটার গভীরতায় উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লার সন্ধান লাভ করে। কয়লাখনিতে ৮২৮ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ থাকলেও সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৬শ ৭৫ মিলিয়ন টন। গড়ে ২৫৭ মিটার মাটির নিচে রয়েছে এই কয়লার মজুত।

এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে খনির জরিপ প্রতিবেদন খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, খালাশপীর কয়লাখনির অবস্থান ১২.২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হলেও সেখানে ৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় কোকিং কোল জাতের উন্নতমানের যে কয়লার স্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে তার শতকরা ২৫ ভাগই অনায়াসে উত্তোলন করা সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখানে বিটুমিনাস নামে উচ্চ জ্বালানি ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লা রয়েছে। প্রতি পাউন্ড কয়লার জ্বালানি ক্ষমতা ১০ হাজার ৫০০ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (বিটিইউ)। এতে ক্ষতিকর সালফারের উপস্থিতি মাত্র এক ভাগেরও কম। খনির এক স্তরে ধাতু গলানোর কাজে ব্যবহৃত কোকিংকোল ও চুনাপাথর এবং কাঁচ বালি রয়েছে, এগুলো অনেক খনিতেই পাওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে এসবের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

এ ব্যাপারে হোসাফ ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়ামের এক কর্মকর্তা (ভূ-তত্ত্ববিদ) নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, দুই বছর ধরে সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করে ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে রিপোর্ট সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এই খনিতে ৪৫১ মিলিয়ন উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লার মজুদ রয়েছে। কমপক্ষে ৫০ বছর ধরে তিন স্তরের ৩শ মিলিয়ন কয়লা থেকে প্রায় দেড়শ মিলিয়ন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। সেখান থেকে কয়লাভিত্তিক ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। যা এ অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে অন্য অঞ্চলে সরবরাহ করা যাবে।

খালাশপীর কয়লাখনি প্রকল্পের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়লা উত্তোলনের জন্য সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি ও দপ্তরে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। এখন পর্যন্ত সাড়া মেলেনি। তবে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেলেই খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু করা হবে। এশিয়ার বৃহত্তম এ কয়লা খনির উন্নতমানের কয়লা গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে জ্বালানি ছাড়াও প্রতিদিন এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

কয়লাখনি প্রকল্পের প্রকল্প প্রধান প্রকৌশলী সামছুদ্দিন জানান, সব কাজ শেষে কয়লা উত্তোলন পলিসি কমিটি গঠন করা হয়। তারা সরেজমিনে এসেছিলেন। এরপর আর অগ্রগতি নেই। মন্ত্রণালয়ে ফাইল পড়ে আছে।

রংপুর অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ওই কয়লাখনি বড় ধরনের একটি সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হতে পারে। খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে তা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের দৃষ্টি কাড়বে। সব মিলিয়ে এই খনির উত্তোলন কাজ শুরু হলে এ অঞ্চলের হাজারো বেকার জনগোষ্ঠীর মাঝে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে বদলে যাবে এখানকার মানুষের ভাগ্য।

পীরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজিমুল ইসলাম শামীম জানান, এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও পীরগঞ্জের পুত্রবধূ শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী বর্তমান সরকারের আমলেই খালাশপীরের খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের অনুরোধ জানান।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোরশেদ হোসেন বলেন, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি না করে এই কয়লা উত্তোলন করলে এই অঞ্চলে শিল্পায়নে তা সহায়ক হবে। উত্তোলনে সর্বাধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। রংপুরের এই কয়লা উত্তোলন করা হলে দেশের অর্থনীতির চেহারাও পাল্টে যাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প ছাড়া উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য খনিজ সম্পদ উত্তোলনে কোনো উদ্যোগ ও কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। খালাশপীরের খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমাদের প্রথম কথা হচ্ছে স্থানীয় জনগণ বা পরিবেশের ক্ষতি করে বাংলাদেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না বা চলবে না। আধুনিক পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হবে। খালাশপীরে সরকার নিশ্চিত করতে পারবে কি না, আগে সেই দিকটা দেখতে হবে।

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান মো. নাজমুল আহসানের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের খনিজসম্পদ উত্তোলন, খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত খুব জরুরি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না এলে কয়লা উত্তোলন করা কঠিন। 

আরআই