‘ডাকাতরা বাসে থাকা প্রত্যেকের কাছে গিয়ে হাত, পা ও চোখ বেঁধে মারধর করে। হত্যার হুমকি দেখিয়ে সবার শরীর তল্লাশি করে টাকা, মুঠোফোন এবং নারী যাত্রীদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকার লুট করে। এ সময় বাসের ভেতরে এক নারী যাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ডাকাতরা।’

কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়া-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ঈগল এক্সপ্রেস বাসটির যাত্রী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সালিমপুর এলাকার ফল ব্যবসায়ী হেকমত আলী। তিনি মঙ্গলবার (২ আগস্ট) রাতে স্ত্রী, দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে ওই বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। 

হেকমত আলী বলেন, বাসটি এর আগে রাত ৮টার দিকে একই উপজেলার প্রাগপুর থেকে ছেড়ে আসে। আমি আমার চার বছরের ছেলে ও দুই বছরের মেয়ে, স্ত্রী জেসমিন আরা ও শাশুড়ি শিল্পী খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া এলাকা থেকে ঈগল এক্সপ্রেস বাসে উঠি। ওই সময় বাসে ১০ থেকে ১৫ জন যাত্রী ছিলেন। বাসটি ভেড়ামারা, লালন শাহ সেতু ও বনপাড়া হয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিরাজগঞ্জের একটি হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে বিরতি শেষে রাত পৌনে ১২টার দিকে ঢাকার দিকে চলতে থাকে।

আরও পড়ুন : চলন্ত বাসে নারীকে ধর্ষণ ক‌রে ৬ ডাকাত

রাত ১২টার দিকে মহাসড়কের ওপর একটি জায়গায় চারজন তরুণ বাসের সামনে থেকে হাত তুলে ইশারা দেন। বাসচালকের সহকারী সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ওই তরুণদের সঙ্গে কথা বলেন। দু-এক মিনিটের মধ্যে তরুণেরা বাসে উঠে পড়েন এবং সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে বাসের পেছনের দিকে গিয়ে বসেন। এই চার তরুণের প্রত্যেকের মুখে মাস্ক ছিল। তাদের একজনের পিঠে ব্যাগ ছিল। তারা পেছনে বসার পরপরই মোবাইল টেপাটিপি করতে থাকেন। বাস আরও ১৫ মিনিটের মতো চলে। এরপর রাস্তা থেকে আরও পাঁচজন একইভাবে বাসে ওঠেন। তারাও কয়েকটি সিটে বসে পড়েন। কয়েক মিনিট পর আরেকটু সামনে গিয়ে আরও দুজন ওঠেন। এর পরপরই বাসের চালককে বাস থামাতে বলা হয়। চালক থামাতে রাজি না হলে তাকে মারধর করে তরুণদের দল। একজন তরুণ দ্রুত তাকে সরিয়ে চালকের আসনে বসে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেন।

হেকমত আলী বলেন, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১০ তরুণ বাসের প্রতিটি সিটের পাশে পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন। তারা পুরুষ যাত্রীদের গলায়  ছুরি ও কাঁচি ধরে রাখেন। তাদের মধ্যে তিন থেকে চারজন দ্রুত বাসের পর্দা কেটে পুরুষ যাত্রীদের মুখ, হাত ও পা বেঁধে ফেলেন। বাসের মাঝখানের লম্বা জায়গায় মাথা নিচু করে তাদের বসিয়ে রাখেন। বাসে থাকা ১০ থেকে ১২ জন নারী যাত্রীর মধ্যে একজনের চোখ, মুখ ও হাত বেঁধে ফেলা হয়। বাকিদের চোখ, মুখ ও হাত খোলা ছিল। ওই একজন নারী যাত্রী আমার শাশুড়ি। বাস তখন স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে। বাসের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। জানালার গ্লাসগুলো আটকে দেওয়া হয়। 

হেকমত আলী জানান, বাসের পেছনের দিক থেকে তিন সিট সামনে বসে ছিলেন তিনি। তার হাত বাঁধা। তার থেকে দুই হাত দূরে এক নারীকে তল্লাশি করার সময় ওই নারী প্রতিবাদ করেন। ওই নারী ডাকাত দলকে বলেন, ‘তোরা যে কাজ করছিস, সেটা ঠিক নয়। আমার এলাকা পাবনায় হলে তোদের দেখে নিতাম।’ এ কথা শোনার পর দুই তরুণ ওই নারীকে মারধর করেন, শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। প্রতিবাদ করায় ডাকাতরা ওই নারীকে ধর্ষণ করেন। 

আরও পড়ুন : চাকরির জন্য ঢাকায় আসছিলেন ভুক্তভোগী সেই নারী

তিনি বলেন, ভোরের দিকে যখন পুলিশ আসে, তখন কয়েকজন যাত্রীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কয়েকজনকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় পুলিশ তাদের দুটি ছবি দেখায়। ছবির দুজন বাসের মধ্যে ছিল বলে যাত্রীরা নিশ্চিত করেন। এরপর গতকাল বুধবার সারা দিন তারা মধুপুর থানাতেই ছিলেন। রাত ৯টার দিকে বিআরটিসির গাড়িতে পুলিশ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে তাদের কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে দেয়।

হেকমত আলীর স্ত্রী জেসমিন আরা বলেন,  আমি সিটে এক সন্তানকে বুকে জড়িয়ে মাথা নিচু করে আল্লাহর নাম নিচ্ছিলাম। সামনে আরেক সিটে আমার মা বসেছিলেন আরেক সন্তানকে নিয়ে। তার হাত, চোখ, মুখ বাঁধা ছিল। ভয়ে আমার শিশু কাঁদছিল, এজন্য ডাকাতরা বলছিল খুন করে ফেলব।

তিনি আরও জানান, ডাকাত দল সব কাজ শেষ করার পর একে অপরকে ডাকাডাকি করে। ডাকাত দলের সরদারকে তারা ‘কাকা’ বলে সম্বোধন করছিল। মাঝেমধ্যে নুরু, সাব্বির, রকি নামেও ডাকা হচ্ছিল। রাত ৩টার দিকে ডাকাতরা টাকা, মুঠোফোন ও স্বর্ণালংকার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি শুরু করে। বাসের ভেতরে ভাগাভাগি নিয়েও তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সড়কের এক পাশে গাড়িটি থামিয়ে দ্রুত তারা নেমে চলে যায়। বাসের ভেতর কোনো যাত্রী মাথা উঁচু করলে বা কথা বলার চেষ্টা করলে তাদের ব্যাপক মারধর করে। 

আরও পড়ুন : যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ডাকাতি

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (২ আগস্ট) রাতে কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী ঈগল পরিবহনের একটি বাসে ডাকাতি ও এক যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। যা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ ঘটনায় ডাকাতি ও ধর্ষণের মূলহোতা রাজা মিয়া নামে একজনকে টাঙ্গাইল শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। 

অন্যদিকে ওই নারীর ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত মিলেছে। টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) দুপুরে ডাক্তারি পরীক্ষার পর বিকেলে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রুমি খাতুনের আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন ওই নারী।

রাজু আহমেদ/আরএআর