থাইল্যান্ডের ভাসমান বাজার দামনোয়েন সাদুয়াকের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। শত বছরের অধিক বয়সী বাজারটির প্রয়োজন না থাকলেও শুধুমাত্র ঐতিহ্যের কারণে আজও টিকিয়ে রেখেছে সেদেশের সরকার। সেই ভাসমান বাজারের চেয়ে আরও মনোরম ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভিমরুলি ভাসমান হাট। 

থাইল্যান্ড সরকার যেখানে ঐতিহ্য আর পর্যটক ধরে রাখতে ভাসমান বাজারটি অবিকল রেখে দিয়েছেন, তার উল্টো চিত্র ভিমরুলির হাটে। নানা টালবাহানায় পর্যটকদের পকেট কাটতে ব্যস্ত সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে ঐতিহ্য হারাচ্ছে এই হাট। তার ওপর নৌযানে আকাশকুসুম ভাড়া, স্থানীয়দের অসৌজন্যমূলক আচরণ, বখাটে পর্যটকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিশৃঙ্খলা বাড়ছে দিন দিন।  

কয়েক বছর আগের জমজমাট ভাসমান হাট না পেয়ে হতাশ পর্যটকরা বলছেন, সঠিক মনিটরিং, ভ্রমণে নিরাপত্তা না দিলে মুখ থুবড়ে পড়বে সম্ভাবনা জাগানো তুমুল জনপ্রিয় এই হাট। ক্ষতি হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির।

পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, ঝালকাঠির ভিমরুলি, বরিশালের বানারিপাড়াসহ এর আশপাশে ছোট-বড় ৩০ স্থানে বসে ভাসমান হাট। এর মধ্যে পেয়ারা ও আমড়ার মৌসুমে সবচেয়ে জমজমাট হয় ঝালকাঠির ভিমরুলি। ভিমরুলির মূল খালের ওপর নির্মিত সেতু থেকে ভাসমান হাটের চমৎকার দৃশ্য দেখা যেত বলে জনপ্রিয়তা পায়। ফলে গত পাঁচ বছরে বর্ষায় ভিমরুলিতে পর্যটকের উপস্থিতি বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় হাট দেখভাল, পর্যটকদের সুবিধার্থে কোনো উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।

হাফেজ মোহাম্মদ মোদাচ্ছিম বিল্লাহ বলেন, এখানে ট্রলার ভাড়া অনেক বেশি। যে পরিমাণে দর্শনার্থী আসছে, সেই তুলনায় ট্রলার নেই। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও ভ্রমণের জন্য ট্রলার পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মতে, এখানকার নৌকা ও ট্রলারের ভাড়া সরকার থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। যেন কোনো পর্যটক হয়রানির শিকার না হন। কারণ সবক্ষেত্রেই সিন্ডিকেট আছে। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়।

ভ্রমণকারী লেডি বাইকার হেনা শ্রাবণ বলেন, ভিমরুলিতে আমরা আসছি ভাসমান বাজার দেখতে। কিন্তু এখানে এসে ভাসমান বাজারের কোনো অস্তিত্ব পেলাম না। এটি দুঃখজনক। এখানে পর্যটকদের প্রচুর ভিড়-বিশৃঙ্খলা। কিন্তু যে বাজার দেখতে আসছে, সেই বাজারটি নেই। অথচ এই অঞ্চলের ঐতিহ্য এই ভাসমান বাজার।

আরেক পর্যটক অশ্রু বলেন, অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল পেয়ারার ভাসমান বাজার দেখব। এই বাজারটি আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেই বাজার আর দেখা যাচ্ছে না। এখানে মানুষ আছে, বাজার নেই। সরকার এবং স্থায়ীদের উচিত ঐতিহ্যবাহী বাজারটি ধরে রাখা। এখানকার ব্যবসায়ী, নৌকা-ট্রলার মালিক, হোটেল মালিকদের একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। অথচ আমরা এখানে এসে দেখছি শুধু বিশৃঙ্খলা। এত কষ্ট করে এলাম অথচ হতাশা নিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।

আরেক পর্যটক বলেন, আমি আগেও এখানে এসেছি। কিন্তু এবার এসে হতাশ হচ্ছি। ট্রলারচালকদের কাছে পর্যটকরা জিম্মি হয়ে আছে। যে যার মতো করে জিম্মি করে ভাড়া আদায় করছেন। এখানকার স্থায়ী সিন্ডিকেটের কারণে মানুষকে তারা জিম্মি করছে। আগে ট্রলার ভাড়া ২৫০ টাকা ছিল। এখন দেখছি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা করেও আদায় করা হচ্ছে।

গণমাধ্যমকর্মী শাওন খান বলেন, মানুষ যে ভাসমান বাজারটি দেখতে আসে সেই চিত্র এখন আর দেখা যায় না। আগে ভিমরুলি মন্দিরের সামনে ভাসমান বাজারটি জমত। অথচ এখন নৌকা সেখানে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না। বরং পর্যটকদের নেওয়ার জন্য বড় বড় ট্রলার সেখানে রেখে দেওয়া হয়। ফলে ভাসমান বাজারের অস্তিত্ব এখন আর নেই। পর্যটকবাহী ট্রলারগুলো যে যার মতো করে ভাড়া আদায় করছে। এত বড় একটি পর্যটন কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক জোন দেখভালের জন্য প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই।

ইয়ুথ অ্যাকশন সোসাইটি ঝালকাঠির সভাপতি শাকিল হাওলাদার রনি বলেন, ভিমরুলিতে পর্যটক হয়রানি বন্ধ ও সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে আমরা মানববন্ধন করেছি। তাতে স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট বাধাও দিয়েছে। মূলত ভিমরুলি ভাসমান হাটে বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা দেখেছি আমরা। ওখানে যে মন্দির রয়েছে তার সামনেই হাটের ঘাট। সেখানে ট্রলার ভিড়ালে মন্দির কমিটিকে ১০০ করে টাকা দিতে হয়। তাছাড়া বিশুদ্ধ পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকার জন্য হোটেল-মোটেল নেই। তাছাড়া ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা উভয়ে ময়লা-আবর্জনা খালে ফেলে নোংরা করে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় কোনো পুলিশও থাকে না। শুধু শুক্রবার দু/চারজন ট্যুরিস্ট পুলিশ আসে। তাতে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না।

কীর্তিপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রহিম মিয়া বলেন, ট্রলার থেকে ১০০ টাকা করে তোলা হয় ঘাট পরিষ্কারের জন্য। তাছাড়া যেখানে ভাসমান হাট জমার কথা বলছেন, সেখানে হাট জমতো না। পর্যটকরা হাট দেখতে পাচ্ছেন না বললে তো হবে না। যে বলছে, তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। 

এই জনপ্রতিনিধি বলেন, পর্যটকদের সুবিধা বাড়ানো ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যারা মানববন্ধন করেছেন, তারা ভুল করেছেন। আসলে মানববন্ধন করার কিছু হয়নি। চেয়ারম্যানের লোক পরিচয়ে মানববন্ধনে বাধা দেওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, সেখানে কেউ মানববন্ধন করেছেন আর কে বাধা দিয়েছেন তা আমি জানি না।  

ঝালকাঠি সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সাবেকুন নাহার বলেন, ভিমরুলিতে ভাসমান বাজারটি বসতে দেওয়া হচ্ছে না, ট্রলার ভিড়ালে ১০০ করে টাকা আদায় করছে মন্দির কমিটিসহ বিভিন্ন অভিযোগ জেনেই আমি এবং জেলা প্রশাসক স্যার গত বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়েছিলাম। আমরা সেখানকার ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক করেছি। এসব সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চলছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাসমান পেয়ারা হাট আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। সেইসঙ্গে পর্যটক যেন হয়রানির শিকার না হন, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুন্দর একটি পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে।

এসপি