একজন প্রকৌশলী, আছেন শিক্ষকতা পেশায়। অন্যজন স্কুলের গণ্ডি না পেরোনো ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী। এই মানুষ দুটির মধ্যে সম্পর্ক ৩০ বছরের। দীর্ঘ এই সময়টাতে তাদের সম্পর্কে এতটুকুও চিড় ধরেনি। একে অন্যের যেকোনো বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। দুইজন যেন দুই দেহে এক প্রাণ। ভালোবাসা-বন্ধুত্ব সবই যেন একে অপরকে ঘিরে। একজন প্রকৌশলী হয়েও বন্ধুর ফুটপাতের দোকানে গিয়ে যেমন বেচা-কেনায় সহযোগিতা করেন তেমনই অপর বন্ধুও ছুটে যান বন্ধুর যেকোনো প্রয়োজনে। 

বলছিলাম সিরাজগঞ্জ পৌরসভার শহীদগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা প্রকৌশলী ও সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিক বিভাগের ইন্সট্রাক্টর রুহুল আমিন ও একই মহল্লার বাসিন্দা শহরের এসএস রোডের ফুটপাতে গার্মেন্টসপণ্য বিক্রি করা ইমরান হোসেনের কথা। 

রুহুল আমিন শহীদগঞ্জ মহল্লার মজনু হোসাইনের ছেলে ও ইমরান হোসেন একই মহল্লার মৃত লোকমান হোসেনের ছেলে। দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ৩ দশকের পুরোনো। এতে কেউ কেউ হিংসা করলেও অনেকেই প্রশংসা করতে ভোলেন না।

তাদের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা দুজনেই ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছেন। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় শিশুকাল থেকেই একসঙ্গে পথচলা শুরু। সেই থেকে বিপদে-আপদে সুখে-দুঃখে দুজন দুজনের পাশে আছেন। এর মাঝে তাদের জীবনে বন্ধু এসেছে অনেক, তবে ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে গেছেন বেশিরভাগই।

সরেজমিনে শহরের এসএস রোডে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতে একটি টেবিল পেতে গার্মেন্টসের জিন্স প্যান্ট বিক্রি করছেন ইমরান হোসেন। তীব্র রোদেও পরিশ্রম করে চলা ইমরানের সঙ্গে কথা হয় সেখানেই। 

ইমরান হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ফুটপাতে টেবিল পেতে গার্মেন্টসের প্যান্ট বিক্রি করি। অভাবের সংসারে পড়াশোনা করতে পারিনি। রুহুল ইঞ্জিনিয়ার, এখন শিক্ষকতা করে। সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। শিশুকাল থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। প্রাইমারি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি, তারপর টাকার অভাবে আমার আর পড়াশোনা করা হয়নি। কিন্তু ও এত ভালো মনের মানুষ যে ও কখনই এটা বুঝতে দেয়নি। আজ পর্যন্ত সব বিপদে-আপদে পাশে থেকেছে। ওর ক্লাস শেষ হওয়ার পরই ও চলে আসে আমার দোকানে।

এসে দোকানে বেচা-কেনা করে আমাকে সহযোগিতা করে। দোকানের প্যান্ট ভাঁজ করে দেয়, কাস্টমারকে দেখায়। এ যুগে কেউ এগুলো করে না, আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাই। ওর মতো এমন বিশ্বস্ত বন্ধু পেলে জীবনে আর কিছুই দরকার হয় না। পরিবার-পরিজন পর হতে পারে, কিন্তু ভালো বন্ধু কখনো পর হয় না। 

তিনি বলেন, কয়েক দিন আগেও আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। সেই সময়েও আমাকে সে যেভাবে সহযোগিতা করেছে তা বলার মতো না। সে সবসময় আমাকে মেধা, পরিশ্রম টাকা-পয়সা দেওয়াসহ সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে।

একটি স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি একবার ঢাকাতে মাল কেনার জন্য যায়। এর মধ্যে রাতে আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওই সময় আমার মেয়ের বয়স দুই বছর। কিন্তু আমি ঢাকা থেকে মাত্র ট্রেনে উঠেছি। ক্রসিংয়ের কারণে দেরি হচ্ছিল। তখন সে আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো করে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু করেছে। আমাকে কিছু বুঝতেই দেয়নি। হয়তো সেই সময়ে রুহুল না থাকলে আমার মেয়েটা বাঁচতোই না। 

তিনি আরও বলেন, কখনো বুঝতে দেয়নি সে একজন শিক্ষিত, সে আমার চেয়ে সামাজিক-পারিবারিক ও আর্থিকভাবে অনেক উন্নত। এমন একজন বন্ধু থাকলে সত্যিই জীবনে আর কিছুই দরকার হয় না।

সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পদার্থ বিজ্ঞানের ইন্সট্রাক্টর সানাউল্লাহ হক বিপুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০১৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর থেকেই এদের দুজনকে চিনি। আমি যোগদানের সময় অধ্যক্ষ রুহুল স্যারকে ডেকে বলেছিলেন, আমার থাকার ব্যাবস্থা করতে। সেই থেকেই তাদের বাড়ির পাশেই থাকি এবং দুজনকেই দীর্ঘ ৮ বছর হলো দেখছি। রুহুল স্যার তার পরিবারের চেয়ে বেশি সময় তাকে দেন।

তিনি বলেন, আমার জীবনে অনেক বন্ধুত্ব দেখেছি, কিন্তু তাদের মতো এমন বন্ধুত্ব আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি নিজেও তাদের বন্ধু হয়ে গেছি। তাদের দুজনের বন্ধুত্বের এমন সম্পর্ক দেখে সবাই হিংসা করে। আমি নিজে যদি রুহুল স্যারকে কোথাও নিয়ে যেতে চাই তিনি ইমরানকে ছাড়া যান না, তখন ইমরানকেও সঙ্গে নিতে হয়। তাদের এই বন্ধুত্ব সত্যিই গর্ব করার মতো এবং এটা সবার জন্য মডেল হতে পারে। 

প্রকৌশলী রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইমরান আমার বয়সে ১-২ বছরের বড়। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বন্ধু হিসেবে বেড়ে ওঠা। পারিবারিক সমস্যার কারণে সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরই পড়াশোনায় থেমে যায়। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছি। কিন্তু সে ফুটপাতে ছোট ব্যবসা করে এবং আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার কোনোভাবেই আমরা কেউই এটা কখনো ভাবি না। ইমরান আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। আমার পরিবারের চেয়ে বেশি সময় আমি ওকে দিই এবং সেও তাই করে। দুজন দুজনার যেকোনো বিপদে পাশে থাকি, সমাধান করার চেষ্টা করি। 

তিনি বলেন, ৩০ বছর পার হয়ে গেছে, কখনো আমাদের মাঝে ঝামেলা বা ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। ধীরে ধীরে ও যেমন আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে আমিও তেমনটাই চেষ্টা করেছি। আসলে দিন শেষে এই বন্ধুত্ব-বিশ্বাস ও ভালোবাসাটুকুই বেঁচে থাকে। কে কোন পেশায় আছি এটা ভাবার সুযোগ নেই। 

তিনি বলেন, পেশা কখনো বন্ধুত্বের সম্পর্কে বিভেদ তৈরি করতে পারে না। অনেকেই বলেন, তুমি একজন শিক্ষক, সে ফুটপাতে পোশাক বিক্রি করে, তার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? তোমাদের মাঝে সামাজিক-আর্থিকভাবে অনেক পার্থক্য। কিন্তু আমি এই কথাগুলো কখনো কানে তুলি না। পেশা দিয়ে বন্ধুত্ব পরিমাপ করা যায় না। তার সঙ্গে বেশি সময় দিই বলে আমার পরিবারের কাছ থেকেও কথা শুনতে হয়। 

আরআই