স্বামী-সন্তান কেউই বেঁচে নেই। জীবনের পড়ন্তবেলায় এখন তার ভরসা একমাত্র নাতনি। কিন্তু কোথায় থাকবে, সেই ঠিকানা আজো নিশ্চিত হয়নি। ভিক্ষাবৃত্তিতে কোনো রকমে দিনপার হলেও রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় অন্যের রান্নাঘরে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী এক ভাতিজার আশ্রয়ে রান্নাঘরে নাতনিকে নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছেন মনিজা বেওয়া। সত্তরোর্ধ্ব এ গৃহহীন বৃদ্ধার একেকটি দিন যেন চরম দুর্দশাগ্রস্ত। কখনো খেয়ে বা না খেয়ে কোনো মতে বিধবা এ নারীর জীবন কাটছে।
 
সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার রাণীপুকুর ইউনিয়নের দৌলত নূরপুর গ্রামে দেখা হয় মনিজা বেওয়ার সঙ্গে। তিনি সেখানকার মৃত আফছার আলীর স্ত্রী। ২০ বছর আগে সুখে-দুখে পাশে থাকা স্বামীকে হারিয়েছেন মনিজা। এখন নিদারুন কষ্টে থাকা এই বৃদ্ধার সঙ্গী বিধবা নাতনি। সরকার থেকে বয়স্কভাতা পেলেও সেই টাকা দিয়ে বিধবা নানি-নাতনির সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দৌলত নূরপুর গ্রামের কাঠমিস্ত্রি মোহাম্মদ মিয়ার বাড়িতে মাত্র দুটি ঘর। গৃহহীন দরিদ্র বৃদ্ধার সংসারেও অভাবের শেষ নেই। তারপরও মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধা মনিজা বেওয়া ও তার নাতনি আঁখি আক্তারকে। রান্নাঘরে থাকেন তারা। ঘরে থাকার মতো পরিবেশ নেই। ভাঙা-চোড়া টিন দিয়ে তৈরি ঘরটি। নেই দরজা-জানালা। মাঝেমধ্যে ওই ঘরে গরু রাখা হয় । তারপরও সেখানে থাকেন বৃদ্ধা মনিজা বেওয়া ও আঁখি আক্তার। 

তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া প্রতিবেশী ভাতিজা মোহাম্মদ মিয়া বলেন, চাচির (মনিজা বেওয়া) আপন বলতে এখন কেউ নেই। তার জীবনটা খুবই কষ্টের। না আছে স্বামী-সংসার। সন্তানও নেই। নিজের মাথা গোঁজার জন্য জমাজমি-বাড়িঘর নেই। চাচি নিজে বিধবা, তার একমাত্র নাতনি সেও বিধবা। আমি নিজেও গরিব, তারপরও আমার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কিন্তু আমিতো তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা করতে পারি না। এ কারণে চাচি বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে জীবনযাপন করছেন।

ওই গ্রামের হামিদা বেগম বলেন, সন্তান প্রসবের সময় মারা যান মনিজা বেওয়ার একমাত্র মেয়ে মাহমুদা বেগম। মাহমুদার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তার বিয়ে হয়েছিল। বছর দুয়েক আগে সেই মেয়ের (নাতনির) স্বামীও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। বর্তমানে বৃদ্ধা মনিজা ও তার নাতনি দুজনে গ্রামের কাঠমিস্ত্রি মোহাম্মদ মিয়ার বাড়িতে রান্নাঘরে থাকেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দৌলত নূরপুর গ্রামের আফছার আলী ছিলেন হতদরিদ্র। অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে চলত তার সংসার। প্রায় ২০ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। বেঁচে ছিলেন একমাত্র মেয়ে। তিনি সন্তান প্রসবের সময় মারা গেছেন। আঁখি আক্তার নামে একজন নাতনি রয়েছে। তাকে লালন-পালন করে বিয়ে দিয়েছিলেন মনিজা বেওয়া। তার স্বামীও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এখন বিধবা নানি-নাতনি মিলে গ্রামের একজনের রান্নাঘরে থাকছেন।

বৃদ্ধা মনিজা বেওয়া বলেন, ‘মুই খুব গরিব, মাইনষের বাড়িত থাকো। চায়া মাঙ্গি খাও। মোর আর আগের মতো শরির চলে না। খুব কষ্টে থাকো বাবা। বিছন্যা নাই, খ্যাতা নাই, কত যে কষ্ট। যেদিন খাবার পাও সেদিন খাও, না পাইলে না খায়া থাকো। মোর পোড়া কপাল, জীবনটাত একনা সুখ পানু না। ভাতার (স্বামী) মরচে, একনা বেটি ছিলো তাও মরচে। নাতনিক বিয়্যাও দিচনু, সেই জামাইও গাড়িত চাপা (সড়ক দুর্ঘটনায়) পড়ি মারা গেইছে। নাতনিটার কপালটাও মোর মতো পোড়া। সরকার যদি হামার দুই বিধবার জনতে কিছু করিল হয়, খুব শান্তি পাইনো হয় বাহে।’

মনিজা বেওয়ার নাতনি আঁখি আক্তার বলেন, নানি আমাকে ছোট থেকে দেখাশুনা করে বড় করেছে। নিজের পছন্দে বিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু কপাল খারাপ হইলে যা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় আমার স্বামী মারা গেছে। আমি এখন নানির সঙ্গে থাকি। মানুষের বাড়িতে কাজকাম করে কোনো মতে খাই। নানি মন চাইলে ভিক্ষা করে। বেশির ভাগ সময়ে রান্নাঘরে শুয়ে বসে থাকে। সরকারি ভাতা পায়, কিন্তু সেই টাকা ওষুধপত্র কিনতে শেষ হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা তবারুকুজ্জামান তুহিন বলেন, ওই নানি-নাতনি খুবই গরিব। কোনো মতে বেঁচে আছে বলা চলে। মানুষের বাড়িতে থাকে। কখনো খায়, বেশিরভাগ সময় না খেয়ে থাকে। তাদের মতো গৃহহীন ভূমিহীন পরিবারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা প্রয়োজন। সরকার তো অনেক ভূমিহীন গৃহহীন পরিবারকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে স্থায়ী নিবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই দুই বিধবার জন্য যদি তেমন কিছু করা যায়, তাহলে গ্রামের মানুষ সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবে।

রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফারুক আল মুজাহিদ বলেন, মনিজা বেওয়া খুবই হতদরিদ্র মানুষ। তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। তিনি নিদারুণ কষ্টে দিনযাপন করছেন। রোগাক্রান্ত অবস্থায় প্রায় খেয়ে না খেয়ে অন্যের রান্নাঘরে থাকেন। আমি সরকারকে তার জন্য কিছু একটা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু ফরহাদ পুটু বলেন, সরকারিভাবে আমরা তাকে বয়স্ক ভাতা দিয়ে আসছি। তবে সেই টাকা দিয়ে তার খরচ, ওষুধপত্রসহ অন্যান্য কিছু সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। শুনেছি এখন নাকি খুবই নাজুক অবস্থা, মানুষের বাড়িতে থাকে। ভিক্ষা করে জীবন চলে। তার মতো গৃহহীন ও ভূমিহীনের জন্য দেখি কিছু করার চেষ্টা করছি। 

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, মনিজা বেওয়া তার একমাত্র বিধবা নাতনিকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ কারণে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে আমরা তাকে একটি ঘর করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক স্যারের পক্ষ থেকে নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তার নাতনি আঁখি আক্তারকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা হবে। আমরা তাদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর নানা সুযোগ-সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর