হাসপাতাল নয়, যেন ভূতুড়ে বাড়ি
হাসপাতাল মানে রোগী ও স্বজনদের দীর্ঘ লাইন, জটলা, রোগী ভর্তির তদবির। তবে উত্তরবঙ্গে একটি হাসপাতাল আছে যেখানে রোগীর কোনো জটলা নেই, দীর্ঘ লাইন নেই, হাসপাতালের সব শয্যাই ফাঁকা। দিনের বেলা সেখানে ঘুরে বেড়ায় পশু-পাখি, রাতের বেলায় থাকে কেবল পাহারাদার। হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে একটি ভূতুড়ে বাড়ি।
লাল ইটের গাঁথুনির নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালের চিত্র অনেকটা এমনই। ৮২ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন রোগী থাকে মাত্র দু-একজন। অন্য হাসপাতালগুলোয় যখন ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগীর চাপ, তখন এই হাসপাতাল পুরোটাই ফাঁকা।
বিজ্ঞাপন
হাসপাতালের অবকাঠামো, অপারেশন থিয়েটার, এক্স-রে রুম, সার্জারি ওয়ার্ড, সাধারণ ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড, কেবিনসহ চিকিৎসার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সবই আছে। শুধু নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল। এক সময়ের রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী আর যাত্রীদের চিকিৎসাসেবার ভরসাস্থল এই হাসপাতালটিতে প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হওয়ার পথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব যন্ত্রপাতি। বিশাল চত্বরে সুবিশাল হাসপাতাল ভবনটি দেখে মনে হবে একটা ভূতুড়ে বাড়ি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে মঞ্জুরি পদের সংখ্যা ১৫০। সেখানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬৬ জন। নার্স, ফার্মাসিস্ট, টেকনোলজিস্টসহ বেশির ভাগ পদেই জনবল নেই। সার্জারি, গাইনি ও প্রয়োজনীয় বিভাগে চিকিৎসকের ৭টি পদের মধ্যে বর্তমানে ৬টিই শূন্য। হাসপাতালটিতে নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, রয়েছে ওষুধের স্বল্পতাও। মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলো পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। এতে পুরোপুরি বন্ধ পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। ফলে রেলের বর্তমান ও অবসরে যাওয়া কর্মচারীরা ও পোষ্যরা হাসপাতালমুখী হচ্ছে না।
সরেজমিনে সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালে দেখা মেলে, মহিলা ওয়ার্ডে সারিবদ্ধ বেডে মাত্র একজন রোগী। রোগী না থাকায় হাসপাতালের স্টাফরাও অলস সময় পার করছেন। পাশে ইমার্জেন্সি কক্ষের দরজা খোলা। সেখানেও দেখা মেলেনি কোনো রোগীর। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমসহ বাকি সব রুম যেন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়।
জানা গেছে, ১৮৭০ সালে দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। একসময় হাসপাতালে রোগীদের ভিড় লেগেই থাকত এবং চিকিৎসাসেবাও ছিল খুব ভালো মানের। কিন্তু এখন আর সেই জৌলুস নেই।
কথা হয় হাসপাতালের সিস্টার ইনচার্জ মশিউর রহমান জুয়েলের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন কারণে এখন আর এই হাসপাতালে মানুষ আসে না। প্রথমত, দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানায় আর জনবল নেই। ৩ হাজার শ্রমিকের এই কারখানা এখন প্রায় ৬০০ জনের মতো আছেন। কারখানার ৭৫ শতাংশ পদ শূন্য এখন। জনবল না থাকায় রোগী আসবে কোথায় থেকে। দ্বিতীয়ত যাদের পে-স্কেল ১৫ হাজার ৮০০-এর ওপরে, তাদের কোনো খাবার দেওয়া হয় না বলে কারখানায় যেটুকু জনবল আছে, তারাও আসেন না আর এখানে সেবা নিতে।
সৈয়দপুর রেলওয়ের কারখানার শ্রমিক জহির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেলওয়েতে যোগ দেওয়ার পর দেখেছি সেখানে প্রতিদিন নিম্ন ২০০ থেকে ৩০০ রোগী আসত চিকিৎসা নিতে, ডাক্তার ছিল ৫ জন, অন্তর্বিভাগে প্রায় ৪০ থেকে ৬০ জন রোগী থাকত। নিউরো ডাক্তার ছিল ৩ জন। ডাক্তার না থাকায় করোনার পর থেকে রোগীর কমে গেছে।
সেবাপ্রার্থী রহুল আমিন বলেন, রেলওয়ের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল এটি। এখানে সেবার কোনো মান নাই। রেলে প্রায় ৫ হাজার পরিবারের সেবা তো একটি ডাক্তার দিয়ে দেওয়া সম্ভব না। এ ছাড়া বাইরে থেকেও মানুষ সেবা নিতে আসে।
রেলওয়ে স্টাফ মোতাহারা বেগম বলেন, রেলের হাসপাতাল, আমরা রেলে চাকরি করি। কিন্তু এখানে নাই তো মহিলা ডাক্তার। শুধু একটা ডাক্তার। মহিলা ডাক্তার না থাকায় আমাদের বাইরে যাইতে হয়।
হাসপাতালের হেড অব অ্যাসিস্ট্যান্ট মকবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এত বড় হাসপাতাল অথচ এই হাসপাতালে কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই। ফলে জটিল রোগীদের রংপুর মেডিকেল কলেজে পাঠাতে সমস্যা হয়। আউটডোরে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ জন রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। হাসপাতালটিতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সরকার একটু উদ্যোগ নিলে সব সংকট দূর হবে।
এদিকে লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতাল ও সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালের প্রশাসনিক দায়িত্ব আছেন একজন ডাক্তার।
দুই হাসপাতালে একই সঙ্গে প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকায় আশানুরূপ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে রেলওয়ে সৈয়দপুরের বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার ডা. আনিছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালটি ৮২ শয্যার। এখানে আমাদের মোট চিকিৎসক থাকার কথা ৭ জন। মাস দুয়েক আগে আমাকে একজন ডাক্তার দিয়েছিল, তিনিও ট্রেনিংয়ে গেছেন। এখন একাই ৭ জনের দায়িত্ব দেখতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমি লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালেরও অতিরিক্ত দায়িত্বে আছি। সেখানেও কোনো ডাক্তার নাই। সেখানেও ১০ জন ডাক্তার থাকার কথা ১০ জনের মধ্যে আমি একা। সব মিলিয়ে ১৭ জন ডাক্তারের কাজ আমি একা করছি। একদিকে আমাকে প্রশাসনিক কাজ করতে হয়, অন্যদিকে রোগীকে সেবা দিতে হয়। এতে রোগী আসলে অপেক্ষা করতে হয়। সেই সঙ্গে এখানে অ্যাম্বুলেন্স নাই এটাও বড় ধরনের সমস্যা।
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. সুজিত কুমার রায় বলেন, আমাদের মন্ত্রী মহোদয় এ বিষয়ে খুব আন্তরিক। চিকিৎসক নিয়োগে বিধি তৈরির কাজ করছে মন্ত্রণালয়। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
এনএ