আবহমান বাংলার এক জলচর পাখি হচ্ছে কালিম। অঞ্চলভেদে এটিকে কালেম, কায়ুম, কালাম, কামিয়া, করমা, সুন্দরী ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। কালিম পাখি খুবই দুঃসাহসী, লড়াকু ও মারকুটে স্বভাবের। দেখতে চকচকে নীলচে বেগুনি। আলতা রঙের কপাল-মাথা ও পা। আর পায়ের আঙুল বেশ লম্বাটে।

প্রকৃতি থেকে দিনদিন হারিয়ে যাওয়া এ বন্য পাখিকে শখের বসে পোষ মানিয়ে বংশপরম্পরায় লালন-পালন করছেন ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায় চারিয়া বিল এলাকার বেশ কিছু পরিবার। হাস-মুরগির মতো লালন পালন করে ডিম থেকে ফোটানো হয় বাচ্চা। শুধু তাই নয়, বিক্রিও হয় বেশ চড়া দামে।  

জল ও ডাঙা উভয় স্থানে বিচরণ করা পাখিটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একবার পোষ মানলে এরা আর উড়ে যায় না। এদের মূল খাদ্য উদ্ভিদ-গুল্মের কচি পাতা, ব্যাঙের বাচ্চা বা ছোট মাছ।

তারাকান্দায় যারা এই পাখি লালনপালন করছেন তাদেরই একজন মনসুর আলী (৭০)। তিনি জানালেন, তার দাদা, বাবা এই কালিম পাখি পুষতেন। তাদের পথ ধরেই শখের বসে নিজেও পুষছেন। 

তিনি আরও জানান, বাড়ির পাশের চারিয়া বিলে বহুকাল আগে থেকেই কালিম পাখির আগমন ঘটত। সেখান থেকেই তার পূর্বপুরুষেরা পাখি ধরে এনে পোষ মানাতেন। ১১০ বছর বেঁচে যাওয়া বাবার কাছ থেকেই মূলত ছোটবেলায় শিখেছেন কীভাবে পোষ মানাতে হয় বদমেজাজি বলে পরিচিত এই পাখিকে। 

মনসুর বলেন, পোষ মানার পর এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় পাখিদের সাথে। যেখানেই থাকুক না কেন ডাক দিলেই উড়ে আসে। আর তাদের ডাকে মন তৃপ্ত হয়। 

গ্রাম ঘুরে কথা হয়েছে আরও কয়েকজনের সঙ্গে। পাখিটি মূলত গৃহিণীরাই লালন-পালন ও দেখভাল করেন। স্থানীয় হাসিনা খাতুন নামে এক গৃহিণী বলেন, হাস-মুরগিকে যে খাবার দেয়া হয় সেই একই খাবার এসব পাখিকে দেয়া হয়। সকালে বের হয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আবার সন্ধ্যায় বাড়িতে চলে আসে কালিম।

রুমেলা খাতুন নামে গ্রামের আরেক গৃহিণী বলেন, পাখি বছরে তিনবার ডিম দেয়। একসাথে আট থেকে ১৫টি ডিম দিয়ে থাকে। সেখান থেকে বাচ্চা ফোটে প্রাকৃতিক নিয়মে। এই পাখি আমরা যারা পালি তারা ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রিও করি। নিয়মিত পাখিটিকে যত্ন করা আর তার খাবার সরবরাহ করা এখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। 

কালিম পাখির আরেক পালক দুলাল মিয়া বলেন- ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ শহরসহ দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে পাখি কিনে নিয়ে যায়। তারাও বাসা-বাড়িতে এগুলো শখ করে পালে। বয়স অনুযায়ী একেকটা পাখি দুই থেকে ছয় হাজার টাকা বিক্রি করা যায়।


 
দ্বীন ইসলাম নামে এক কিশোর বলেন, আমরাও ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি কালিম পাখি। আমাদেরও শখ এ পাখি পালার। বিশেষ করে পাখির ডাক অনেক ভালো লাগে। ঝগড়া দেখতেও ভালো লাগে। বিল অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়, দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। 

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্য প্রাণী আইনে পাখি ধরা, মারা, বিক্রি ও পোষা দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই লালনপালন করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই করতে হবে। 

ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা ইয়াছমিন বলেন, আইনে বলাই আছে বন্যপ্রাণী শিকার বা লালনপালন নিষিদ্ধ। শুধু নিষিদ্ধই না, দণ্ডনীয় অপরাধ। সেক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে লালনপালন করলে সেটা বৈধ হবে।

যারা দীর্ঘদিন ধরে পোষ মানিয়ে যাচ্ছেন তাদের সাথে পাখির সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রার। তাই তাদের সচেতন করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে মনে করেন ফাহমিদা ইয়াছমিন। বলেন, যদি সরকার মনে করে এভাবে পাখিটার সংখ্যা বাড়ছে, তাহলে মানুষকে সচেতন করতে হবে। আর সংখ্যা বাড়লে পরিবেশে কিছু সংখ্যক পাখি ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে যদি উৎসাহী করা যায় তাহলে পাখিটা বনেও বাঁচবে এবং পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হবে। একইসাথে পরিবারগুলো যে উদ্দেশ্যে পাখি পালন করছে সেটিও সফল হবে।

জানা গেছে, প্রজনন মৌসুমে দুই পুরুষ পাখি যখন লড়াই করে, তখন কপালে কপালে লাগে টক্কর। শব্দ শোনা যায় অনেক দূর থেকেও। বর্ষাকালই হলো কালিম পাখির প্রধান প্রজনন ঋতু। ‘জোড়’ না মিললে বা ভালো সঙ্গী না পেলে এরা ডিম পাড়ে না। প্রচলিত আছে, স্ত্রী কালিমের মন জয় করে তবেই পুরুষ কালিমকে মিলনে যেতে হয়। আর স্ত্রী কালিমের মন জয় করার জন্য পুরুষ কালিমকে শারীরিক কসরত দেখাতে হয়। 

মাথায় আলতা রঙের রক্ষা কবচের জন্য অনেকেই এই পাখিকে তুলনা করেন রোমান যোদ্ধাদের সাথে। প্রচলিত আছে, এরা এতটাই দুঃসাহসী ও লড়াকু যে শিকারীদের ছোড়া গুলি এক পায়ে লাগলেও, মুখে সেই পা কামড়ে ধরে উড়ে পালাতে পারে। এক সময় ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেঁষা শেরপুরের নালিতাবাড়ী পাহাড়ি এলাকায় কালিমের অবাধ বিচরণ থাকলেও এখন আর তেমন দেখা মেলে না।

এইচকে/এসএসএইচ