ফরিদপুরের ভাঙ্গা পৌরসভার নুরপুর মহল্লায় খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। শনিবার (১৩ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে তার সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। ভাঙ্গার তারেক মাসুদ ফাউন্ডেশন, ফরিদপুর তারেক মাসুদ ফিল্ম সোসাইটি ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম সম্মিলিতভাবে তারেক মাসুদের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে। 

পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পর আয়োজিত স্মরণসভায় তারেক মাসুদের সহধর্মিণী ক্যাথরিন মাসুদ বলেন, তারেক মাসুদ ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। জাতিকে ভালোবাসার ভাবনা তার সব সময় ছিল। তাকে একজন চিন্তাবিদও বলা যায়। দেশের মানুষ, ইতিহাস ও চলচ্চিত্র আন্দোলন নিয়ে তিনি সব সময় ভাবতেন।

তিনি আরও বলেন, তারেকের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গার নুরপুরে। তিনি ভাঙ্গা ও ফরিদপুরকে অন্যরকমভাবে ভালোবাসতেন। তারেক মাসুদের মৃত্যুর ১১ বছর পার হয়ে গেছে। তারপরও তারেক মাসুদ আমাদের সঙ্গে আছে।

ক্যাথরিন মাসুদ বলেন, চলচ্চিত্রের বাইরেও তারেকের আরও অনেক কিছু বলার ছিল, করার ছিল। তার অকাল মৃত্যু সব কিছুতে যেন একটা ছেদ এনে দিয়েছে। তারপরও তারেককে নিয়ে বই প্রকাশিত হচ্ছে। বইয়ের মাধ্যমে তার ভাবনা-স্বপ্ন ছড়িয়ে যাবে দেশের মানুষের কাছে। তরুণ প্রজন্মকে তারেকের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, তবেই তারেকের স্বপ্ন, তারেকের আত্মদান সার্থক হবে। 

ভাঙ্গা তারেক মাসুদ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক মোসায়েদ হোসেন ঢালীর সভাপতিত্বে স্মরণসভায় আরও বক্তব্য দেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যপক চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন, ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিম উদ্দিন, সাংবাদিক মফিজ ইমাম মিলন, শিবচর রিজিয়া বেগম মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বাবুল আশরাফ, ভাঙ্গা উপজেলা পরিষেদের সাবেক চেয়ারম্যান সুধিন কুমার সরকার, বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সভাপতি জহিরুল ইসলাম প্রমুখ। 

স্মরণসভা চলাকালে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তারেক মাসুদের মা নুরুন্নাহার মাসুদ (৮৮)। তবে তিনি বক্তব্য দেননি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, তারেক এখন আমাদের জাতিসত্তার উপাদান। যেমন উপাদান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তারেককে অস্বীকার করে আমরা যারা শিল্প মাধ্যমে আছি তারা দিন যাপন করতে পারি না।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, তারেকের চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতা আমাদেরকে মোহিত করত। মানুষ হিসাবে তারেক প্রাণবন্ত, সৃষ্টিশীল, ভালো মানুষ। তাকে ভালো না বেসে পারা যেত না।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে প্রধান অতিথি নাসির উদ্দীন ইউসুফ তারেক মাসুদের গ্রামের বাড়িতে ‘তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র পাঠকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। পরে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের পক্ষ থেকে তারেক মাসুদকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সভাপতি জহিরুল ইসলাম সম্মাননা ক্রেস্ট ও সনদ তুলে দেন তারেক মাসুদের মা নুরুন্নাহার মাসুদ ও তারেক মাসুদের সহধর্মিণী ক্যাথরিন মাসুদের হাতে।

ওই অনুষ্ঠানে সাংবাদিক মফিজ ইমাম সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র’ নামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এর আগে তারেকের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয় বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ‘কাগজের ফুল’ এর শুটিং লোকেশন দেখে ঢাকায় ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা নামকস্থানে বিপরীতমুখী চুয়াডাঙ্গা এক্সপ্রেসের একটি বাসের সঙ্গে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন। মুক্তির গান, মাটির ময়না, আদম সুরত, রানওয়েসহ বেশ কিছু  সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন তারেক মাসুদ। তারেক মাসুদ ভাঙ্গার নুরপুর গ্রামের মসিউর রহমান মাসুদ-নুরুননাহার দম্পতির ছেলে। তার বাবা ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তারেক সবার বড়।

শৈশবে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করেছেন তারেক মাসুদ। এরপর তিনি ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ঢাকায় চলে যান। সেখানে নটরডেম কলেজ ও আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়াশোনা শেষে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।

জহির হোসেন/আরএআর