ছেলেবেলা থেকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সুরাইয়া জাহান ও সৈকত খানের বেড়ে ওঠার যুদ্ধটা এক ও অভিন্ন। তবে সকল প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে পরিবারের অনুপ্রেরণায় এবং নিজেদের অদম্য ইচ্ছায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এবার অংশ নিয়েছেন গুচ্ছভিত্তিক ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায়। 

শনিবার (১৩ আগস্ট) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা দেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি সরকারি চাকরি করে পরিবারের হাল ধরার স্বপ্ন তাদের। 

শেরপুর সদরের আন্দারিয়া সুতিরপাড় এলাকায় বড় হয়ে উঠেছেন সুরাইয়া জাহান। জন্ম থেকেই হাত অকেজো। ভাষাও অস্পষ্ট। তাকে ভাববিনিময় করতে হয় চোখের ইশারায়। তবে তার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া। কোনো প্রতিবন্ধকতাতেই দমে যাননি। প্রথমবার কোথাও ভর্তির সুযোগ না পেলেও পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকে দ্বিতীয়বার গুচ্ছতে অংশ নিয়েছেন সুরাইয়া। পরীক্ষায় লিখেছেন পা দিয়ে। 

বাবা ছফির উদ্দিন চরপক্ষীমারি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। মা মুর্শিদা গৃহিণী। তিন সন্তানের মধ্যে বড় ও ছোট দুই সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনায় উচ্চ শিক্ষিত করতে চায় পরিবার। 

মা মুর্শিদা বলেন, চলতে-লিখতে না পারা আমার বড় মেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। তাই আমরাও তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি যতটা ভালো রাখা যায়। এই লড়াই করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে আমাদের খুশির শেষ থাকবে না। নজরুল ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারলে আমাদের জন্যও ভালো ছিল। সুরাইয়াও এখানে ভর্তি হতে চায়। 

পা দিয়ে লিখেই সুরাইয়া চরকান্দারিয়া হাইস্কুল থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে এসএসসিতে ৪.১১ এবং শেরপুর মডেল গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসিতে ৪.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

সুরাইয়ার চেয়ে গল্পটা ভিন্ন সৈকতের। ছোটবেলা থেকে শারীরিকভাবে ভিন্ন হওয়ায় বন্ধুদের কাছে ছিলেন অগ্রহণযোগ্য। তবে বাবার অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন এবার। বাবা সবুজ খানের সঙ্গেই সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে।

দরিদ্র কৃষক সবুজ খানের তিন সন্তানের দুইজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। কৃষিকাজ থেকে আসা অর্থ দিয়েই সন্তানের স্বপ্ন পূরণে পড়ালেখা করাতে চান দরিদ্র এই বাবা। সৈকত সুনামঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার জনতা মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পান ৩. ৫০ এবং ধর্মপাশা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ৩.৫৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এবার নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। 

সৈকত বলেন, আমি অনেক কিছুতে অক্ষম হলেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। সব বাধা অতিক্রম করে এই পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে চাই। যোগাযোগের সুবিধার জন্য আমি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে চাই। 

সৈকতের বাবা সবুজ খান বলেন, আমার ছেলেটা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তাই তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাকে পড়াশোনা করিয়েছি। আমার কষ্ট হলেও সব সময় পড়াশোনার খরচ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ আমি চাই সে যেন ভালো থাকে। 

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, আমরা নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করেছি, যেন তারা ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারে। এমনকি তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বিবেচনায় নিয়ে অতিরিক্ত সময়ও দেয়া হয়েছে।

শনিবার দুপুর ১২টা থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে 'বি' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে আসন পড়ে ৭ হাজার ৭৮৩ জনের। পরীক্ষায় অংশ নেয়নি ৭০১ জন। পরীক্ষায় উপস্থিতির হার ৯১ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ অনুষদের ১২৫টি কক্ষে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এমএএস