নিজেরও স্বপ্ন ছিল শিক্ষিত হওয়ার। কিন্তু অভাবের কারণে তা করতে পারেননি মকিম উদ্দীন। কোনোমতে নাম দস্তখত ছাড়া আর কোনো অক্ষরজ্ঞান নেই তার। তবে সে আক্ষেপ তাকে সব সময় তাড়া করত। তাই নিজে না পারলেও সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

মকিম উদ্দীনের সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবতার মুখ দেখতে যাচ্ছে। শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করা ও ভ্যান চালিয়ে আয় করা টাকা দিয়ে দুই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন চীনে।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মকিমউদ্দীন। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তিনি রিকশা চালিয়েছেন। ৫ বছর ধরে ভ্যান চালাচ্ছেন। এখন দৈনিক আয়ের একটা অংশ দিয়ে সংসারের ভরণপোষণ করছেন তিনি। বাকি টাকা দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ হিসেবে চীনে পাঠিয়ে দেন।

মকিম উদ্দীনের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে। বড় ছেলে হবিবুর রহমান চীনের জিয়াংসু ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ডিজাইন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচার অটোমেশন বিভাগে পড়াশোনা করছেন। ছোট আবুল হাসিম একই ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

হাজারো কষ্টে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় সমাজে এক সফল ও গর্বিত বাবার সম্মানের জায়গা তৈরি হয়েছে মকিম উদ্দীনের। তার পরিবারও সমাজের কাছে এক আদর্শ পরিবার হিসেবে ভূষিত হচ্ছে।

মকিম উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২৮ বছর পা দিয়ে রিকশা চালিয়েছি। এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাচ্ছি পাঁচ বছর ধরে। ছোটবেলায় আমাদের অনেক অভাব থাকায় পড়াশোনা তেমন করতে পারিনি। আমাদের সময় যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, তারা শুধু পড়াশোনা করত। তবে আমি পারিনি, তাই ইচ্ছা ছিল আমার সন্তানদের অন্তত পড়াশোনা করাব।

তিনি আরও বলেন, এক বিঘা আবাদি জমি ছিল আমার। বড় ছেলে বলল, সে চীনে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করবে। আমি ভেবেছি, ছেলে উচ্চশিক্ষিত হলে অনেক আবাদি জমি কিনতে পারবে। তাই জমিটা বিক্রি করে ছেলেকে চীনে পাঠিয়েছি পড়াশোনার জন্য। পরে আবার ছোট ছেলেও চীনে গেছে। এখন প্রতি মাসে তাদের জন্য টাকা পাঠাতে হয়।

একমাত্র আয়ের পথ ভ্যান, এমনটা জানিয়ে বৃদ্ধ মকিম বলেন, দৈনিক যা আয় হয়, তার কিছু রেখে সবটুকু তাদের জন্য পাঠাই দিই। আমরা স্বামী-স্ত্রী কখনো খাই, কখনো না খেয়ে থাকি। কাউকে বলি না এসব কষ্টের কথা। আমি ভ্যান নিয়ে বাইরে যাওয়া বাদ দিই না। আমি বসে থাকলে সন্তানদের টাকা পাঠাব কী করে? আমার কষ্ট হোক, তবু তারা ভালো ইঞ্জিনিয়ার হোক, এটাই আমার চাওয়া। সবাই আমার সন্তানদের জন্য দোয়া করবেন।

মকিম উদ্দীনের স্ত্রী হুসনে আরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ে দুটাকে অনেক কষ্ট করে বিয়ে দিছি। আর ছেলে দুটাকে পড়াশোনা করাচ্ছি। তাদের নিয়ে কষ্টের কথা মনে হলে আমার বুকটা ফেটে যায়। মনের অজান্তেই কান্না আসে। কখনো খাইছি, কখনো খাইনি। তবু সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়েছি। পৈতৃক এক বিঘা আবাদি জমি ছিল। ছেলে দুটোর জন্য তা বিক্রি করতে হয়েছে। একমাত্র ভ্যানটিই এখন আমাদের সম্বল।

তিনি আরও বলেন, ছেলেদের বাবার অনেক বয়স হয়েছে। তবু প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে বের হন। কোনো দিন তিনি বসে থাকেন না। আজ ছেলেরা চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করছে। প্রতি মাসে টাকা দেওয়া লাগে। ছেলে দুটাও অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। আমাদের যত কষ্টই হোক, আমরা তাদের উচ্চশিক্ষিত করাতে চাই। আপনারা সবাই দোয়া করবেন আমার ছেলেদের জন্য।

চীন থেকে মোবাইল ফোনে কথা হয় হবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৯ সালে চীনে ডিপ্লোমা পড়াশোনা করতে আসি। আমি আমার মা-বাবাকে চীনে আসার বিষয়টি অবগত করি। পরে বাবা তার শেষ সম্বল ৩৩ শতাংশ জমি বিক্রি করে দেন। আমার বাবা কোনো প্রশ্ন না করেই রাজি হয়ে যান। তাই আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, আমার বাবা ভ্যান চালিয়ে আয় করে আমাদের টাকা পাঠান। বাবা মাঝেমধ্যেই বলতেন, বাবা, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তোমাদের যে কবে কিছু একটা হয়। আমি বাবাকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে যে বাবা, আমরা তো দুই ভাই এখানে ভালোমতো পড়াশোনা করছি। ইনশা আল্লাহ খুব শিগগিরই আপনি একটা সুসংবাদ পাবেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা দুই ভাই পড়াশোনা শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করব। কারণ, আমাদের দেশ উন্নত দেশগুলোর থেকে এখনো অনেকটা পিছিয়ে আছে। আমাদের মেধা ও শ্রম দেশের জন্য কাজে লাগাতে চাই। আমাদের খুব ইচ্ছা দেশে গিয়ে গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করব।

প্রতিবেশী নিপু আক্তার বলেন, সম্পর্কে তারা আমার চাচা-চাচি হন। কত কষ্ট করে চাচা তাদের পড়াশোনা করাচ্ছেন, তা বলার মতো নয়। আমারও সন্তান আছে। আমি ভাবি, তাদের মতো পরিশ্রম করে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারব কি না। তবে তারা আমাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। কষ্ট ও পরিশ্রম করে সব কাজ করা যায়, এর দারুণ দৃষ্টান্ত চাচার দুই ছেলে।

প্রতিবেশী ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান বাবলু বলেন, তারা দিনে এনে দিনে খান। এর মধ্যেও অনেক কষ্ট করে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন মকিম চাচা। অনেক অভাবেও তারা সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ রাখেননি। বিষয়টি আসলে অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো। আমরা আশা করছি, তারা দক্ষ প্রকৌশলী হয়ে এলাকা ও দেশসেবায় নিয়োজিত থাকবেন।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভ্যান চালিয়ে বৃদ্ধ বাবা দুই ছেলেকে চীনে পড়াশোনা করাচ্ছেন, বিষয়টি অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো। এখান থেকে বোঝা যায়, যদি মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে, তবে সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। এটি আমাদের জন্য আনন্দায়ক বিষয়। যদি কখনো তার প্রয়োজন হয় সহযোগিতার, তবে উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে দাঁড়াবে।

এনএ