একসময় আপনজনের চিঠির অপেক্ষায় থাকত মানুষ। কখন পোস্ট অফিসের ডাকপিয়ন বাড়িতে এসে ‘চিঠি’ বলে ডাক দেবেন। কিন্তু ই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমের কারণে সেসব এখন রূপকথার গল্প মন হবে।

এ ছাড়া দেশ-বিদেশে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বরাবর টাকা পাঠানোর মাধ্যম ছিল ডাক বিভাগের পোস্টাল অর্ডার। এখন বিশ্বায়নের যুগে অনলাইন বা মোবাইল ব্যাংকি-সুবিধায় টাকা লেনদেন হয়। ফলে দুটি মাধ্যমের আধুনিকীকরণের কারণে পোস্ট অফিসের গুরুত্ব কমেনি শুধু, হারিয়ে গেছে।

এত পরিবর্তনের পরও পোস্ট অফিসে জীবন বিমা, সঞ্চয়পত্রে টাকা জামানত রাখা, জরুরি কাগজপত্র কম টাকায় পাঠানোর জন্য পোস্ট অফিসের গুরুত্ব এখনো অপরিহার্য। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার টেরকি পোস্ট অফিসের ভগ্নদশার কারণে এখানে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারছে না কেউ।

জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে সহদেবপুরের টেরকি এলাকায় পোস্ট অফিসটি স্থাপন করা হয়। স্থানীয় মৃত আব্দুর রহিম ফকির পোস্ট অফিসের জন্য ৮ শতাংশ জায়গা ওয়াকফ করে দেন। সেই জায়গায় পোস্ট অফিসটির কার্যক্রম শুরু হয়।

সরেজমিনে উপজেলার সহদেবপুর ইউনিয়নের টেরকি এলাকায় দেখা গেছে, জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘টেরকি পোস্ট অফিস’। যার পোস্ট কোড নম্বর ১৯৭৪। টিনের একটি ঘর হলেও নেই দরজা। টিনগুলোও মরিচা ধরে খসে খসে পড়ছে। ঘরের সামনে একটি ডাকবাক্স ঝুলছে। ঘরের ভেতরে চিঠি রাখার কাঠের বাক্সটিও পড়ে রয়েছে। বৃষ্টির পানিতে ঘরের মেঝে ধসে পড়েছে। পোস্ট অফিসের রুগ্ন দশায়র কারণে চার বছর ধরে সেখানে কোনো কার্যক্রম চলে না। ফলে পোস্ট মাস্টারের বাড়িতেই চলে পোস্ট অফিসের কার্যক্রম। পোস্ট অফিস থেকে ২০০ মিটার দূরেই পোস্টমাস্টারের বাড়ি।

তবে পোস্ট অফিসে তালাকনামা পত্র, চাকরির নিয়োগপত্র ছাড়া তেমন কোনো জরুরি চিঠি আসে না। পোস্ট অফিসের কোনো ডাকটিকিট না থাকায় দুই বছর ধরে কোনো চিঠিও পাঠাতে পারেন না সেবাপ্রার্থীরা। তবে পোস্ট অফিসের জায়গায় আরেকটি টিনের ঘরে ভোটকেন্দ্র বানানো হয়েছে। এখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। পাশেই আরেকটি পাকা ঘরে বেসরকারি একটি এনজিও সংস্থার পাঠশালা করা হয়েছে। এতে সেখানে স্থানীয় ছেলে-মেয়েরা কম খরচে পড়াশোনা করতে পারে।

স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে পোস্ট অফিসের বেহাল। কোনো সংস্কার নেই। ভোটের সময় এলে এলাকার মানুষ সেখানে ভোট দিতে যায়। পোস্ট অফিসে একজন ডাকপিয়ন ও মাস্টার থাকলেও কোনো চিঠি পাঠানো যায় না। তবে মাঝেমধ্যে চাকরির নিয়োগপত্র, তালাকনামাপত্রসহ কয়েকটি চিঠিপত্র পাওয়া যায়। কম খরচে চিঠি পাঠানোর সুযোগ থাকলেও এখানে সেই সুবিধা পাওয়া যায় না। পোস্টমাস্টারের বাড়িতেই এখন পোস্ট অফিসের কার্যক্রম চলে। কেন্দ্র থেকে সারা দেশে ডাক বিভাগকে ডিজিটাল করা হলেও বা করার সুযোগ থাকলেও গ্রামের মানুষ এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

এদিকে পোস্ট অফিসের প্রাইজ বন্ড বিক্রি ও ভাঙনো, সঞ্চয়পত্র বিক্রয় ও ভাঙানো, ডাক বিমা, ইএমএস, ডাকটিকিট বিক্রি, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, সব ধরনের চিঠিপত্র ইস্যু ও বিলি, পার্সেল সার্ভিস এবং ইএমটিএস সার্ভিসের মতো কার্যক্রম থাকলেও কোনো সেবাই টেরকি পোস্ট অফিসে পাচ্ছে না গ্রামের করদাতা মানুষগুলো।

টেরকি পোস্ট অফিসের ডাকপিয়ন সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পোস্ট অফিসটি জীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। কোনো সংস্কার করা হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে চিঠিপত্র আসে। তবে তালাকনামাপত্র বেশি আসে পোস্ট অফিসে। টিকিট না থাকায় কোনো চিঠি পাঠানো যায় না। আমার দাদা এই পোস্ট অফিসের জন্য জায়গা দান করেছিলেন। সেই সুবাদে বেতনবিহীন সম্মানীর মাধ্যমে পোস্ট অফিসে কাজ করছি।

টেরকি পোস্ট অফিসের মাস্টার মাহবুব আলম বলেন, পোস্ট অফিসে আগের মতো চিঠিপত্র আসে না। এর বেহাল দশার কারণে বাড়ি থেকেই কার্যক্রম পরিচালনা করছি। চিঠি এলে রানারের মাধ্যমে গ্রাহকদের চিঠি পাঠিয়ে দিই। এ ছাড়া অনেকে এসে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি নিয়ে যায়। এখান থেকে রেজিস্ট্রি-বিহীন চিঠি পাঠাতে ৩ টাকা ও রেজিস্ট্রি করে পাঠাতে ১০ টাকা খরচ হয় গ্রাহকদের।

তিনি আরও বলেন, একসময় টাকা লেনদেন হতো। এখন কোনো টাকাই লেনদেন হয় না। ডাকঘরের যেসব ডিজিটাল সেবা চলমান আছে, সেসবও এলাকার মানুষ পাচ্ছে না। তবে আধুনিক ও ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে পুনরায় কার্যক্রম চালু করলে মানুষ কম খরচে সেবা পাবে বলে মনে করেন তিনি।

উপজেলার সহদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান খান জানান, পোস্ট অফিসটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাবাসীর জন্য। ৯টি গ্রামের মানুষ পোস্ট অফিসের উপকারভোগী। তবে জীর্ণদশার কারণে পোস্টমাস্টারের বাড়িতে চলে কার্যক্রম। এর আগে স্থানীয় এমপির মাধ্যমে পোস্ট অফিসে ঘর করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাটিও ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি আধুনিকভাবে শুরু করা যায়।

জেলার ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল মোহাম্মদ ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাখা পোস্টগুলোর জীর্ণদশা থাকলেও পোস্টমাস্টার যেকোনো স্থানে বসে কার্যক্রম চালাতে পারেন। তার বাড়ি, স্থানীয় ফার্মেসিসহ যেকোনো জায়গায় পোস্ট অফিসের কার্যক্রম করা যাবে। যেহেতু তারা সম্মানীতে কাজ করেন, সেহেতু পোস্ট অফিস কার্যক্রম চালাতে তেমন বিধিনিষেধ নেই। এরপরও ওই পোস্ট অফিসের বিষয়ে খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এনএ