ভোলায় ‘পুলিশের গুলিতে’ রাজনৈতিক কর্মী নিহতের ঠিক ১৫ দিনের ব্যবধানে বরগুনায় ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের ওপর ‘অমানবিক’ লাঠিচার্জে নজিরবিহীন সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, দুটি ঘটনায় পেশাদারি আচরণ ছিল না পুলিশের। এসব ক্ষেত্রে আরও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারত পুলিশ। কিন্তু তা না করায় অস্থিরতা বাড়বে রাজনৈতিক অঙ্গনে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।

যদিও আলোচিত এ দুটি ঘটনার বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি এস এম আক্তারুজ্জামান। তিনি দাবি করেছেন, এসব ঘটনায় রাজনৈতিক নেতারা অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন।

মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) দুপুরে ডিআইজি বলেন, বরগুনায় ঘটে যাওয়া এত বড় ঘটনায় সেখানকার রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। আমিও তাদের আশ্বস্ত করেছি যে এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাজনৈতিক নেতারা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন।

পুলিশকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশের সঙ্গে নাটক বা মঞ্চের মতো ‘এ ঘটনার পর ও ঘটনা ঘটবে, আবার ওই ঘটনার পর আরেকটি ঘটবে’ এমন ধারাবাহিকভাবে কিছু হয় না। এ কারণে পুলিশকে খুব দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মাঠে যখন একটি ঘটনা ঘটে যায়, আমরা দূর থেকে একভাবে দেখি, আর যারা মাঠে কাজ করেন, তারা আরেকভাবে দেখেন।

এস এম আক্তারুজ্জামান বলেন, উদাহরণ হিসেবে বলতে হয়, বরগুনায় যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে একটি পক্ষ কিন্তু সংবাদ সম্মেলন করে বলছে, পুলিশ ভালো কাজ করেছে। আরেকটি পক্ষ বলছে, পুলিশ ভালো কাজ করেনি। ভোলায়ও একই অবস্থা। দুটি পক্ষ থাকেই। দুপক্ষের মাঝামাঝি দেখাটাই আমাদের কাজ। পুলিশের পর্যবেক্ষণ আবার একটি মাত্রায় সীমাবদ্ধ করতে পারি না। এসব ঘটনা অনেক ক্ষেত্র বিবেচনায় দেখতে হয়। পুলিশের নৈতিকতা, প্রশিক্ষণ, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি— সবকিছু সুনির্দিষ্টভাবে দেখতে হয়। সামগ্রিকভাবে বলব, কাজ করতে গেলে ভুলত্রুটি হবে, এরপরও আমরা এগিয়ে যাব।

বরগুনায় লাঠিপেটার সময় পুলিশ সদস্যের গায়ে পোশাক পরা ছিল না, এমন প্রশ্নের জবাবে এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের পোশাক কখন পরিধান করবেন, কখন পরিধান করতে হবে না, তার জন্য আলাদা নির্দেশনা রয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে অবশ্যই পুলিশ সদস্যকে পুলিশের পোশাক পরিধান করতে হবে।

তিনি জানান, বরগুনার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যাকে নিয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহররম আলীকে বরগুনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বরিশাল রেঞ্জ কার্যালয়ে নিযুক্ত করা হয়েছে।

দুই ঘটনায় বিশিষ্টজনদের মন্তব্য
দুটি ঘটনা নিয়েই বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সরব স্থানীয় ব্যক্তিরা। এমনকি বরিশালের বিশিষ্টজনরাও কথা বলেছেন ভোলা ও বরগুনার ঘটনা নিয়ে।

বিশিষ্ট কবি হেনরী স্বপন বলেন, ভোলা ও বরগুনায় ছিল রাজনৈতিক কর্মসূচি। দুটি কর্মসূচিকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বিভিন্নজনের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জেনেছি। আমি মনে করি এই দুই স্থানে পুলিশ পেশাদার আচরণ করেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া বাংলাদেশ পুলিশ তো জনগণের পুলিশ হবে। আমি চাই পুলিশ রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে আরও সহনশীল ও পেশাদারি আচরণ করবে।

বরিশাল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যাল মনে করেন, বরগুনার ঘটনায় ছাত্রলীগ ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানে মারামারি কেন করল, সেই বিষয়ে আগে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত এবং পুলিশ যদি অতিরঞ্জিত কাজ করে, তার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ছাড়া ভোলার ঘটনায় আমি মনে করি ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মাঠে নামতে না দেওয়ার পরিকল্পিত ফল হচ্ছে দুজন নিহত হওয়া। উভয় ঘটনায় পুলিশের আচরণ খতিয়ে দেখা উচিত।

সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও পুলিশের এমন আচরণ আমরা কেউ প্রত্যাশা করিনি। এই দুই স্থানের বিষয়ে যদি কোনো ব্যক্তি অপরাধ করত, তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা যেত। কিন্তু দেখলাম, নেতা-কর্মীরা গাড়ি ভেঙেছে, পুলিশ মানুষ ভেঙেছে। পুলিশের এমন আচরণ সত্যিকার অর্থেই বাড়াবাড়ি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, পুলিশ গুলি করে মানুষ মারবে আবার ১৫ আগস্টের কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের ওপর অমানবিক লাঠিচার্জ করবে, এটা আমরা আশা করি না। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলার সদস্যসচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ভোলায় পুলিশের গুলিতে বিএনপির নেতা-কর্মী নিহত এবং বরগুনায় জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিতে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিপেটা কোনো সভ্য দেশের পুলিশের আচরণ হতে পারে না। এসব স্থানে যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, পুলিশের কাজ হবে সেই অপরাধীকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু পুলিশ গণহারে মানুষের ওপর লাঠি চালাতে পারে না, গুলি চালাতে পারে না। তার মানে সে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আরেকটি অপরাধ ঘটাল। আর এ দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে হয়তো একটি বার্তাও দেওয়া হচ্ছে, রাজনৈতিক অঙ্গনের চেয়ে পুলিশ শক্তিশালী। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই চর্চা ভয়াবহ খারাপ লক্ষণ। আমি মনে করি পুলিশের এই অপেশাদারি আচরণে তদন্ত করে তাদের বিচার হওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, ভোলায় ৩১ জুলাই বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ‘পুলিশের গুলিতে’ দুজন নিহত হয়েছে, এমন অভিযোগে সেখানকার থানার পুলিশ পরিদর্শকসহ ৩৬ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এদিকে ১৫ আগস্ট বরগুনায় জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মারামারি ঠেকাতে গিয়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীর নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম।

এ সময় সেখানকার সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা বলে ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের একটি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এনএ