ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ১১ নং মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাতৃগাঁও মোহাম্মদপুর গ্রামের মোখলেসুর রহমানের ছেলে কামরুজ্জামান। তিনি এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে অর্থের অভাবে তার ভর্তি অনেকটাই অনিশ্চিত।

জানা গেছে, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন হার্ট অ্যাটাক করেন কামরুজ্জামানের বাবা। তখন থেকে পরিবারে নেমে আসে নানা সংকট। অভাব-অনটন যেন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। বাবার ওষুধ, সংসার খরচ ও নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে তার স্বপ্ন ছিল স্থির। নানা প্রতিবন্ধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন।

কামরুজ্জামান বলেন, পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার আগে বাবা হার্ট অ্যাটাক করেন। চিকিৎসা নেওয়ার কিছু দিন পর সুস্থ হলেও ফের হার্ট অ্যাটাক করেন। তখন থেকে বাবা আর কিছু করতে পারেন না। আমি আর মা সব কাজ করি। পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া আমার কাছে ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, হাইস্কুলে পড়ার সময় শিক্ষকরা আমার কাছ থেকে কোনো টাকা নিতেন না। বরং বিভিন্ন সময়ে আমাকে তারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। তারা সব সময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন ও পাশে থেকেছেন। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হয়। বাড়ির কাজ, অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচ নানা ধরনের দুশ্চিন্তা নিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যায়। ফলস্বরূপ এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাই।

তারপর ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বৃত্তি পাই। তাদের বৃত্তির টাকায় ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করি। এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছি। আমার ইচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো- এখন কেউ বৃত্তি দেবে না। আমি কীভাবে যাতায়াত করব আর ভর্তি হবো। সব মিলিয়ে আমি ও আমার পরিবার দুশ্চিন্তায় আছি। যদি সরকারের পক্ষ থেকে বা সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসে, তবেই আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।

কামরুজ্জামানে মা কামরুন নাহার বলেন, আমার স্বামী ১২ বছর ধরে অসুস্থ। দুইবার হার্ট অ্যাটাক করেছেন। কোনো কাজ করতে পারেন না। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করি। ছেলেকে কখনো খাওয়াতে পারছি, কখনো পারিনি। অনেক কষ্ট করে ছেলেটা পড়াশোনা করছে। আমি যা আয় করি, তা নিজে খেতে আর ওষুধ কিনতে চলে যায়। ছেলেটাকে যে ভালো খাওয়াব সেটা কখনো পারিনি। কষ্ট করে লেখাপড়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাইছে। এখন ঢাকা পাঠাব কেমনে? ভর্তির খরচ কোথায় পাব? আমার কোনো উপায়ও নেই। আপনারা যদি এগিয়ে আসেন তবে আমার ছেলেটা পড়তে পারবে।

বাবা মোখলেছুর রহমান বলেন, আমি দুই বার হার্ট অ্যাটাক করি। আমাকে ডাক্তার ঢাকা যাওয়ার কথা বলেছিল কিন্তু টাকার অভাবে যেতে পারিনি। ওষুধ খেতে খেতে একদম শূন্য হয়ে গেছি। আমার ছেলেটা খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। আমার সংসার চলে না, ওষুধ কিনতে পারি না। কীভাবে এখন তাকে পড়াশোনার খরচ দেবো? আমি মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। আমাকে বাইপাস করাতে বলেছিল কিন্তু টাকার অভাবে করাতে পারিনি। আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার ছেলেটা কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। আমার ছেলেটাকে আপনারা সাহায্য করুন। সে যেন ভালো মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।

প্রতিবেশী হারেছা বেগম বলেন, ওর মা কোনো দিন বাসায় বসে থাকে না। সারা দিন পরিশ্রম করে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে আবার নিজের সংসারের কাজ করে। ছেলেটার পাশে সরকারের দাঁড়ানো উচিত। 

প্রতিবেশী আকবর আলী বলেন, এদের বসতভিটা ছাড়া আর কোনো জায়গা-জমি নেই। অন্যের জমি চাষ করে সংসার চালাতেন। এখন ওর বাবা অসুস্থ। বিছানায় পড়ে আছে। আমরা সকলে মিলে চিকিৎসার খরচ দিয়েছি। এখন সংসার চালাবে, না ওষুধ কিনবে নাকি পড়াশোনার খরচ চালাবে? ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। সকলের এগিয়ে আসা উচিত। আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি।

ওই ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য সলেমান আলী বলেন, স্কুল-কলেজে পড়াশোনার সময় আমরা তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি। তার বাবা একেবারে অক্ষম। তার মা সংসার চালায় অন্যের বাড়িতে কাজ করে।

মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও গিলাবাড়ী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলী বলেন, নিঃসন্দেহে ছেলেটি অনেক মেধাবী। তার বাবা প্রায় এক যুগ ধরে বিছানায় পড়ে আছে। তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। আমরা তাকে সহযোগিতা করেছি মাঝে-মধ্যে। সম্প্রতি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ভর্তি ও আনুষঙ্গিক খরচের জন্য তার পরিবার দুশ্চিন্তায় রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তার পাশে দাঁড়ানোর। সরকার ও সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে এ মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সম্পদে রূপান্তরিত করা যাবে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মো. শামসুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কামরুজ্জামান বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি তার বাবা দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ। তার পরিবারও বেশ অস্বচ্ছল। তার পড়াশোনা যেন থেমে না যায়, সেজন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে। 

এম এ সামাদ/এসপি