মুক্তারুজ্জামান মুক্তার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দুই ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারছেন না পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান মুক্তারুজ্জামান মুক্তার। তিনি উপজেলার সদর ইউনিয়নের গোয়াবাড়ি গ্রামের পাথরশ্রমিক মোশারফ হোসেনের ছেলে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মুক্তারুজ্জামান মুক্তারের বাবা মোশারফ হোসেন মহানন্দা নদীতে পাথর তোলেন আর মা হনুফা বেগম পাথর ভাঙার কাজ করেন। এ দিয়েই কোনোভাবে চলে তাদের সংসার। গত সাত বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে আছে মুক্তারের বড় বোন মোকসেদা খাতুন মুক্তি। টাকার অভাবে তারও চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না। চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ও ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে খ ইউনিটে ৬৫৪তম ও ঘ ইউনিটে ৬৩তম হয়ে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছেন মুক্তারুজ্জামান মুক্তার। 

রোববার (২১ আগস্ট) সকালে মুক্তারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা মোশারফ হোসেন নদীতে পাথর তুলতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একমাত্র ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় খুশি তিনি। তবে কীভাবে ছেলের ভর্তির টাকা জোগাড় করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। নিজের ভিটে-বাড়ি ছাড়া কোনো জমিজমা নেই তার। 

মোশারফ হোসেন বলেন, ছেলেটা (মুক্তার) ছোট থেকেই মেধাবী। যার কারণে ওর লেখাপড়ায় কোনো ভাটা পড়ুক তা চাইনি। কষ্ট করেই পড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখন সে দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, কীভাবে যে তার ভর্তির টাকা জোগাড় করবো কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। যদি কেউ সহযোগিতা করতেন, তাহলে ছেলেটার স্বপ্ন পূরণ হতো।

মুক্তারুজ্জামান মুক্তার বলেন, কঠিন দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই আমার বেড়ে ওঠা। পঞ্চম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত জিপিএ-৫ না পেলেও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করি। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে ভর্তি হই পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে কলেজে যেতে হতো। মেসে থাকার সামর্থ্য না থাকায় কষ্ট করে বাসে যেতাম কলেজে। ২০২১ সালে এই কলেজ থেকে মানবিক শাখায় পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ অর্জন করি। এখান থেকেই স্বপ্ন তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার। সে স্বপ্নকে জয় করতেই লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী হই।

পরিবার হতদরিদ্র হওয়ায় চরম হিমশিম খেতে হয়। এ জন্য বাবার সঙ্গেও কাজ করতে হয় আমাকে। লেখাপড়া চালাতে টিউশনি করাতে শুরু করি। সে টাকা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ ও ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে খ ইউনিটে ৬৫৪তম ও ঘ ইউনিটে ৬৩তম হয়ে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছি। এ জন্য আমাকে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এখন ভর্তির টাকা নেই, জানি না টাকা কীভাবে জোগাড় হবে?

মুক্তারের মা হনুফা বেগম বলেন, ছেলেটাকে তেমন কিছু দিতে পারিনি। আমরা স্বামী-স্ত্রী পাথরের কাজ করছি। এ দিয়ে সংসার চলে না। তাই ছেলেটাকে ভালো কিছু দিতে পারি না। মুক্তার নিজে নিজে প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা জোগাড় করে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। এখন তার ভর্তি হতে অনেক টাকা দরকার। কীভাবে সেই টাকা জোগাড়করবো জানি না। সমাজের বিত্তবান বা সরকারের কাছে ছেলের জন্য সাহায্য চাই। 

এলাকার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোকসানা, সাইফুল ইসলাম সবুজ ও রায়হান হাসান জানায়, মুক্তার ভাই এই এলাকায় খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী। আমরা তার কাছে প্রাইভেট পড়ি। কিন্তু মুক্তার ভাইয়ের পারিবারিক অবস্থা ভালো না। তারপরও এখান থেকে বেড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়া সত্যিই গর্বের বিষয়। আমরাও এখন স্বপ্ন দেখছি- একদিন মুক্তার ভাইয়ের মতো এ রকম দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। তার পাশে দাঁড়ালে খুব ভালো হয়।

রনচন্ডী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিউর রহমান বুলবুল বলেন, মুক্তার খুব মেধাবী ছেলে। আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। সে যখন এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, তখন আমরা ৭-৮ হাজার টাকা সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম। সে খুব অসহায় পরিবারের ছেলে। এখন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ লেখাপড়া চালিয়ে যেতে অর্থের প্রয়োজন। সমাজের বিত্তশালীদের তার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাই। 

স্থানীয় ইউপি সদস্য নুর ইসলাম বলেন, মুক্তারুজ্জামান মুক্তার এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। খুব অসহায়ভাবে দিন যাপন করে তারা। ওর মতো একটা ছেলে আমাদের এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, এটা সত্যিই গর্বের বিষয়। সমাজের বিত্তশালীরা যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে সে আরও এগিয়ে যেতে পারবে এবং আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে মুক্তারুজ্জামান মুক্তারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়ে শুনেছি। এ রকম প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে, দরিদ্র পরিবার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া গর্বের বিষয়। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুক্তারের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিসহ লেখাপড়া চালাতে কিছু টাকার ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি তার বড় বোন যেহেতু মানসিক প্রতিবন্ধী, তিনি যেন ভাতা পান তার ব্যবস্থাও করা হবে। 

মুক্তারুজ্জামান মুক্তারকে সহযোগিতার জন্য ০১৩১৫১৩৫০৬৪ এই নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন। 

আরএআর