২০২০ সালে পড়াশোনা শেষ করে বেকার বসে না থেকে একটা কিছু করার পরিকল্পনা করেন তিন বন্ধু। সিদ্ধান্ত নেন এলাকায় একটি মাল্টা বাগান করবেন। পরে তারা বিভিন্ন এলাকার মাল্টা বাগান পরিদর্শন করে অভিজ্ঞতা নেন। ইউটিউবে ভিডিও দেখে মাল্টা বাগান করতে আরও উদ্বুদ্ধ হন।

ওই বছরই তারা ৬৫ শতাংশ (সাড়ে ৬ কাঠা) পতিত জমিতে বারি-১, বারি-২, ডোরাকাটা এবং চায়না ভিয়েতনামিসহ চার প্রজাতির ৩৩৫টি মাল্টা গাছ রোপণের মাধ্যমে বাগান শুরু করেন। বর্তমানে বাগানের প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে মাল্টা। এসব মাল্টা বিক্রি করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিন বন্ধু। 

আরও পড়ুন : এমবিএ করা তারেক মাছ চাষে দেশসেরা

নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের রাজি নদীর তীরে তিন বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছেন এই মাল্টা বাগান। তাদের এমন উদ্যোগে সাড়া ফেলেছে পুরো এলাকাজুড়ে। তাদের দেখে কৃষি উদ্যোক্তা হতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন স্থানীয় শিক্ষিত বেকার যুবকরাও।

 

মাল্টা বাগান করা তিন বন্ধু হলেন- কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও তেতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদের ছেলে কেন্দুয়া সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস  রিজন আহমেদ, একই উপজেলার চিরাং ইউনিয়নের বানিয়াগাতী গ্রামের রহিছ উদ্দিন মিয়ার ছেলে কেন্দুয়া সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস তামিম ইকবাল রাসেল এবং উপজেলার বলাইশিমুল ইউনিয়নের সরাপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুস ছাত্তারের ছেলে ময়মনসিংহ সরকারি পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস মোহাইমিনুল ইসলাম তমাল। 

রোববার (২১ আগস্ট) দুপুরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় উদ্যোক্তা তিন বন্ধুর। তারা জানান, রিজন আহমেদ এবং মোহাইমিনুল ইসলাম তমাল আপন মামাতো-ফুফাতো ভাই। তামিম ইকবাল রাসেল তাদের বন্ধু। দুই বছর আগে করোনাকালে বেকার বসে না থেকে তারা একটা কিছু করার পরিকল্পনা করেন। আর সেই পরিকল্পনা থেকেই গড়ে তোলেন মাল্টা বাগান।

আরও পড়ুন : আমে ক্ষতিগ্রস্ত, সৌদি খেজুরে যুবকের বাজিমাত

মোহাইমিনুল ইসলাম তমাল বলেন, ইউটিউবের মাধ্যমে মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হই। এ সময় আমাদের আত্মীয় অ্যাডভোকেট সেকুল ইসলাম সাগর ব্যাপক অনুপ্রেরণা যোগান। আমরা তখন বিভিন্ন এলাকার মাল্টা বাগান পরিদর্শন করি। পরে ২০২০ সালে তেঁতুলিয়া গ্রামে রাজি নদীর পাড়ে আমার মামার সাড়ে ৬ কাঠা (৬৫ শতাংশ) জমিতে তিন বন্ধু মিলে শুরু করি মাল্টা বাগান। বাগানে বারি-১, বারি-২, ডোরাকাটা এবং চায়না ভিয়েতনামিসহ ৪ প্রজাতির মোট ৩৩৫টি মাল্টা গাছ লাগাই। গত মার্চ মাসে গাছগুলোতে প্রথম ফুল আসে। বাগানটি করতে ব্যাপক সহযোগিতা করেন স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন ভূঞা বাচ্চু এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একেএম শাহজাহান কবির। 

তিনি বলেন, বাগানের গাছগুলোতে যখন মাল্টা ধরতে শুরু করে ঠিক তখনই আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। এতে বাগানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। বাগানের ৪০টি গাছ মারা যায়। এখনো ৫-৬টি গাছ আক্রান্ত রয়েছে। বর্তমানে ২৯৫টি মাল্টা গাছের মধ্যে ২০০ গাছে মাল্টা ধরেছে। যা আগামী সেপ্টেম্বর মাসে বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি। 

রিজন আহমেদ ও তামিম ইকবাল রাসেল বলেন, আমাদের বাগানে মাল্টা গাছের পাশাপাশি থাই-৭ আম, গোপালভোগ আম এবং থাই-৭ পেয়ারাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ১০০ লেবু গাছও লাগানো হয়েছে। প্রতিদিনই আশপাশের মানুষ আমাদের বাগান দেখতে আসে। তাছাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বাগান পদির্শন করেন এবং পরামর্শ দেন। 

তারা আরও বলেন, আমাদের তিন বন্ধুর স্বপ্ন হল বিশাল একটি বাগান তৈরি করা এবং এই বাগান থেকে লাভবান হওয়া। আমরা আশা করছি আমাদের এ স্বপ্ন পূরণ হবে। তবে তাদের বাগানে একটি ভার্মি কম্পোস্ট প্রদর্শনী স্থাপনের জন্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা। 

আরও পড়ুন : স্বামীর ইচ্ছে পূরণে মাশরুম চাষ করে সাড়া ফেলেছেন মেহেরুন

স্থানীয় যুবক সেলিম আকন্দ বলেন, তিন বন্ধু রিজন, তমাল ও রাসেলের মাল্টা বাগানটি এলাকায় সাড়া ফেলেছে। দীর্ঘদিন চেষ্টার পর তাদের বাগানের গাছে গাছে মাল্টা ঝুলছে। আমি নিজেও বাগানটি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। এলাকার অনেকেই তাদের বাগান দেখে কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠছে। চাকরির আশায় অহেতুক দৌড়ঝাঁপ না করে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের মতো দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকরা কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করলে দেশে বেকার সমস্যারও সমাধান হবে।

একই এলাকার নুর মিয়া বলেন, মাল্টা বাগানটির পাশেই আমার বাড়ি। আমি সময় পেলেই বাগানটা দেখতে চলে আসি। এখানে আগে পতিত একটা ভিটা ছিল। কিন্তু তিন বন্ধু মিলে বাগান করায় জায়গা যেমন কাজে লেগেছে, তেমনি তিন বন্ধুও এই বাগানের ফল বিক্রি করে লাভবান হতে পারবে। এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমি তিন বন্ধুকে ধন্যবাদ জানাই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কাশেম বলেন, আমার এলাকার শিক্ষিত তিন যুবক যে মাল্টা বাগানটি গড়ে তুলেছেন, আমি সেটা দেখেছি। খুবই চমৎকার একটি বাগান তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন। চাকরির ওপর নির্ভর না করে অত্যন্ত পরিশ্রম করে তারা এ মাল্টা বাগানটি গড়ে তুলেছেন। বাগানের প্রতিটি গাছেই এখন মাল্টা ঝুলছে। এ থেকে তারা বেশ লাভবান হবেন এবং স্বাবলম্বী হয়ে উঠারও সম্ভাবনা রয়েছে। 

আরও পড়ুন : পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, গড়ে তুলেছেন খামার

এ বিষয়ে কেন্দুয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একেএম শাহজাহান কবির বলেন, তিন বন্ধুর মাল্টা বাগানটি খুবই চমৎকার। আমাদের পরামর্শ মতে তারা কাজ করছেন। গাছে গাছে প্রচুর মাল্টা এসেছে। দেখলে খুবই ভালো লাগে। এই বাগানের মাল্টাগুলো এখনই প্রচুর মিষ্টি। রং ধরতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বরে পাকবে। তারা ভালো লাভবান হবে বলে আশা করছি। 

ওই বাগানে বার্মি কম্পোস্ট প্রদর্শনী স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রকল্পের আওতায় ভার্মি কম্পোস্ট প্রদর্শনী দিয়ে থাকি। মূলত গোবর, কচুরিপানা, পচা লতা-পাতা ও কেঁচোর মাধ্যমে উৎপন্ন সারের নামই হল ভার্মি কম্পোস্ট। সুযোগ এলে আমি সেখানে ভার্মি কম্পোস্ট প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করব।

জিয়াউর রহমান/আরএআর