কোচ নম্বর ১২৬৫। পরিচিত প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচ নামে। কোচের ভেতর লালগালিচায় মোড়ানো কাঠের ছয়টি কামরা। পুরোটাই সেগুন কাঠের তৈরি। চমৎকার রং আর বৈচিত্র্যপূর্ণ নকশা সেই কাঠজুড়ে। ছয় কামরাবিশিষ্ট এই কোচের প্রতিটি কক্ষেই আছে কাঠের তৈরি কারুকার্যখচিত খাট, কাপড় রাখার আলমারি, নান্দনিক ডিজাইনের লাইটিং, ফ্যান, এসি ও দামি ফার্নিচার।

পুরো কোচে লাল মখমলের কার্পেটিং করা। প্রতিটি কক্ষের সঙ্গে একটি করে অ্যাটাচ বাথরুম ও বেলজিয়ামের উন্নত স্যানিটারি ফিটিংস। বোঝাই যায় না, এগুলো শত বছর আগের তৈরি। ব্রিটিশ আমলের এসব আসবাব বর্তমান সময়ের আধুনিকতাকেও হার মানায়।

বলছিলাম ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের ভারতবর্ষ ভ্রমণের জন্য ১৯২৭ সালে তৈরি হওয়া বিলাসবহুল ট্রেনের কোচ প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচের কথা। যেটি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ক্যারেজ শপে। সেখানে কিছু জিনিস মেরামত করে কোচটি সাধারণ মানুষ ও দর্শনার্থীদের জন্য নেওয়া হবে কারখানার নবনির্মিত জাদুঘরে।

জানা গেছে, দেশভাগের পর বৃটিশ সরকার তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান রেলওয়েকে এই সেলুন কোচটি উপহার হিসেবে দিয়ে যায়। এরপর থেকে এটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির জন্য সংরক্ষিত থাকায় এর নাম হয় রেলওয়ে প্রেসিডেন্ট সেলুন।  দেশের প্রেসিডেন্টদের ট্রেন ভ্রমণের জন্য কোচটি বরাদ্দ রাখা হয়। তখন এটিকে রাষ্ট্রপতি সেলুন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনিই একমাত্র এই সেলুন ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৮১ সালে এটি চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়লে মেরামতের জন্য আনা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ক্যারেজ শপে দেখা মেলে কালের সাক্ষী এবং রেলওয়ের ঐতিহ্যের স্মারক প্রেসিডেন্ট সেলুনটির। কোচটির ভেতরে প্রবেশ করে মনে হতেই পারে এটি কোনো আধুনিক বাসভবন। প্রবেশদ্বারেই রয়েছে কোচটির ইতিহাস সংবলিত একটি ওয়ালবোর্ড। এক পা এগুলেই চোখে পড়বে একটি কামরা। এটি নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। এরপর রয়েছে রানির সঙ্গে আগত পাইক-পেয়াদা ও তার স্টাফদের জন্য থাকার কক্ষ।

এরপরে দেখা মেলে একটি সভাকক্ষের। এটি অন্যগুলোর তুলনায় বেশ বড়। বড় দুটি সোফা রাখা আছে সেখানে, সেই সোফার সামনে আছে ৮ থেকে ১০টি চেয়ার। যার সব কটিই সেগুন কাঠের তৈরি।  নান্দনিক কারুকার্য দেয়ালজুড়ে। লালগালিচা আর সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো পুরো কনফারেন্স রুম। সেখানে কক্ষের সঙ্গে লাগানো আলমারিতে আছে ডিংকস কেস, মদের বোতল রাখার তাক, আছে সিগারেটের ছাইদানি। রয়েছে এসি, নান্দনিক ডিজাইনের লাইটিং, ফ্যান, উন্নত কাঠের ফার্নিচার আর দামি ঝাড়বাতি।  

সভাকক্ষ পেরিয়ে সামনে এগোলেই দুই বিছানার একটি বেড রুম। এটি রানির জন্য বরাদ্দ ছিল। সেখানে আছে খাট, ফোল্ডিং বেসিন। দোতলা আলমারি, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার জন্য তামার তৈরি ছোট ছোট দুটি পাত্র, ঝাড়বাতি। এরপর এক কক্ষজুড়ে বাধরুম। পুরো কক্ষটিই যেন পাঁচ তারকা হোটেলের আদলে গড়া। 

পুরো দেয়াল উন্নতমানের ছোট ছোট টাইলসে বাঁধানো, সিমেন্ট বা বালু দিয়ে না, স্ক্রু দিয়ে আটকানো প্রতিটি টাইলস। সিলিংও সবুজ টাইলস মোড়ানো। মেঝেতে কাঠের ওপর মোজাইক। আছে সেই আমলের উন্নত হাই কমোড, সেখানকার ঝাড়বাতিগুলোও নকশা করা, কালারফুল ও নান্দনিক। দেয়ালজুড়ে তামা-পিতলের আলপনা। সাবান-শ্যাম্পু আর ব্রাশ রাখার জন্য আছে তামার তৈরি নান্দনিক ঝুড়ি, যাতে গৌরবময় আভিজাত্য ফুটে ওঠে। সেই ওয়াশরুমে আছে বিশাল সবুজ মার্বেলের বাথটাব, আছে পিতলের ঝরনা। এরপরের কামরাটি বাবুর্চিদের থাকার জন্য। সেখানেও রয়েছে কাঠের দুটি খাট। এরপরের কক্ষটি রান্নাঘর।

মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, ভেতর থেকে বোঝার উপায় নেই এটি কোনো কোচ। বাইরে থেকেও বোঝার উপায় নেই এই কোচের ভেতরের অবস্থা। লাইটগুলো অচল হওয়ায় আলোর জন্য নতুন করে লাইট স্থাপন করা হয়েছে। সাধারণ কোচে ৮টি চাকা থাকলেও সেলুনটিতে রয়েছে ১২টি চাকা। বর্তমানে সেলুন কোচটি কারখানার ক্যারেজ শপে থাকলেও সেখানে কিছু জিনিস মেরামত করে সাধারণ মানুষ ও দর্শনার্থীদের জন্য নেওয়া হবে নবনির্মিত রেলওয়ে জাদুঘরে।

কারখানার ক্যারেজ ইনচার্জ মোমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি ১৯২৭ সালে বৃটিশদের  নির্মিত বিশেষায়িত একটি কোচ। এই কোচটির বৈশিষ্ট্য হলো এর অবকাঠামোটা পুরোটা কাঠের। এখানে বৃটিশ রানির সভাকক্ষ আছে, বেডরুম আছে। বলা যায় আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাই আছে। এটি বর্তমানে ব্যবহার না হলেও, আমরা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে রেখে দিয়েছি। যাতে আগামী প্রজন্ম এটিকে দেখতে পারে।  আমাদের যে যাদুঘর আছে সেখানে স্থানান্তর করা হবে।

কারখানার ডিভিশনাল সুপারিনটেন্ডেন্ট (ডিএস) সাদেকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সর্বপ্রথম রানি এলিজাবেথ এই সেলুন কোচে ভ্রমণ করেন। পরবর্তীকালে এটা পরিবর্তিত হয়ে প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৮১ সালে এটি চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। তৎকালীন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে, এটি জাদুঘরে স্মৃতি হিসেবে থাকবে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের এই সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় এটি আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছি।

তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষ যদি আগ্রহী হন, তারা বিভিন্ন সময়ে আমাদের রেলওয়ে জাদুঘরে ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত মালামাল ও রক্ষিত যন্ত্রপাতি পরিদর্শন করতে পারেন। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে-  আমরা বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বড় কোনো জাদুঘর তৈরি করে এই স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণ করব। যাতে সাধারণ মানুষ এগুলাকে দেখতে পায়। 

প্রসঙ্গত, নীলফামারীর সৈয়দপুর দেশের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই শহর অনেক আগে থেকে প্রসিদ্ধ হলেও অনেকের কাছে রেলের শহর হিসেবে বেশি পরিচিত। ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমির ওপর সৈয়দপুরে নির্মিত হয় দেশের প্রাচীন এবং বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ রেল কারখানার ২৬টি উপ-কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন। রেলের ছোট বড় যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ লাইনের বগি মেরামতসহ সব কাজ করা হয় এই কারখানায়। রেলওয়ে সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জনে দেশের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই কারখানা পরিদর্শন করেন।

আরএআর