ফরিদপুরের সদ্য বিদায়ী পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামানের সরকারি কার্যালয়ের দরজা সবার জন্য সব সময় খোলা থাকত। ধনী,  দরিদ্র, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ সবাই অবাদে ঢুকতে পারতেন তার কক্ষে। সম্প্রতি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি। তাকে ঢাকায় র‌্যাবের পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) ফরিদপুরে ছিল তার শেষ কর্মদিবস। বুধবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে ঢাকার উদ্দেশ্যে ফরিদপুর ত্যাগ করেন তিনি। 

আলিমুজ্জামানের ছিলেন জনবান্ধব পুলিশ সুপার। তিনি ফরিদপুরে যতদিন পুলিশ সুপার ছিলেন, ততদিন তার কাছে এসে সর্বস্তরের জনগণ নিঃসংকোচে বলতে পারতেন তাদের সমস্যার কথা, অভিযোগ করতে পারতেন যে কোন বিষয়ে। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সেটিও সংকোচহীন ও নির্ভয়ে চিত্তে তুলে ধরতে পারতেন।

সবাইকে সময় দিতেন পুলিশ সুপার। সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। যেটি তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান যোগ্য তার সমাধান করে দিতেন। যে সমস্যার সমাধানের জন্য প্রাথমিক আইনগত পদক্ষেপ নিতে হয় তার পথও বাতলে দিতেন। কোনো থানায় ফোন করে দিতে হলে সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করে দিতেন। এভাবে ভিন্ন মাত্রায় গত প্রায় তিন বছরের আধিককাল ফরিদপুরের সর্বস্তরের মানুষের কাছে আপনজন, একজন কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন মো. আলিমুজ্জামান।

আলিমুজ্জামান ফরিদপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই। ওই সময় ফরিদপুরে চলছিল খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং তার তিন সহযোগী আলোচিত দুই ভাই শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল এবং খন্দকার মোশাররফের এপিএস তৎকালীন জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এ এইচ এম ফোয়াদের রাজত্ব। ওই সময় কোনো জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপার ফরিদপুরে এলে ওই চক্রের নির্দেশনার বাইরে কাজ করার কোনো সুযোগ ছিল না, ছিল না চেষ্টাও। এর মধ্যে পুলিশ সুপার হিসেবে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মো. আলিমুজ্জামান।

ফলে আলিমুজ্জামানের ওপর অসন্তুষ্ট হন ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ ও তার সহযোগীরা। ২০২০ সালের ১৪ মে ফরিদপুর থেকে ছোট জেলা মেহেরপুরে পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয় আলিমুজ্জামানকে। তবে পরবর্তীতে সে আদেশ বাতিল হয়ে যায়।

২০২০ সালের ১৬ মে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলা এবং ওই ঘটনায় ১৮ জুন মামলার সূত্রধরে ওই বছরের ৭ জুন ফরিদপুরে শুরু হয় পুলিশের শুদ্ধি অভিযান। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান। ওই রাতে (৭ জুন, ২০২০) খন্দকার মোশাররফের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেলকে। ওই দিন গ্রেপ্তার এড়িয়ে পালিয়ে যেতে পারলেও পরে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় খন্দকার মোশাররফের এপিএস ফোয়াদকে। আরও পরে গ্রেপ্তার হন মোশররফের ভাই ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেসাম হোসেন ওরফে বাবর। তারা সকলে বর্তমানে দুই হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিং মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছেন।

ওই ঘটনার পর থেকে পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামানের প্রতি ফরিদপুরের সর্বস্তরের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়।

মো. আলিমুজ্জামান ১৯৭৬ সালে ১৬ আগস্ট নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার ধোপাধাহ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা অলিয়ার রহমান ও মা মনিরা বেগম। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তিনি বিবাহিত এবং এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। ব্যক্তিজীবনে অতি সাধারণভাবে চলাফেরা করেন আলিমুজ্জামান। নিজে কম দামি পোশাক পরেন। স্ত্রী-সন্তানদের জন্যও একই ব্যবস্থা। যারা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপারের বাসভবনে গেছেন, তাদের এ দৃশ্যটি চোখে পড়েছে।

জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে সারাদেশে করোনার প্রদুর্ভাব শুরু হলে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ঘরে থাকা মানুষদের বিনোদন দেওয়ার জন্য পুলিশ সুপারের উদ্যোগে পুলিশ সদস্যদের দিয়ে গান পরিবেশন করা হয় শহরের বিভিন্ন অলিতে গলিতে। ওই সময় ফরিদপুরে কর্মরত সকল পুলিশ সদস্যদের এক দিনের বেতন এবং সুশিল সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে মোট ২০ লাখ টাকার সহায়তা তহবিল গঠন করা হয়। এই টাকা দিয়ে বিনামূল্যে ভ্রাম্যমাণ অক্সিজেন ব্যাংক স্থাপন, লকডাউন চলাকালে আটকা পড়া শ্রমিকদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ, গোপনে মধ্যবিত্তদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়। ওই সময় প্রচণ্ড সামাজিক বিরোধিতার মুখে করোনার কারণে মৃত্যু হওয়া ব্যক্তিদের সৎকারও করা হয়।

হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী বই খাতা, পোশাকসহ শিক্ষাসামগ্রী প্রদান করেন আলিমুজ্জামান। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সমন ও ওয়ারেন্ট ইস্যু পদ্ধতি চালু করায় সমন ও ওয়ারেন্ট তালিমের হার বেড়ে যায়। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের ফুলসহ গাড়ির বহরে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেন। পুলিশ সদস্যদের সন্তানদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করেন। 

দুই দুস্থ নারীকে পুনবার্সনের জন্য দুটি সেমি পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেন। এই দুই নারী হলেন চরভদ্রাসন ইমতাজ মোল্লার ডাঙ্গী সোনাই বিবি (৬০) এবং অপরজন শহরের চুনাঘাটা এলাকার বাসিন্দা বিধবা মাহফুজা বেগম (৪৮)।

ফরিদপুরে পুলিশদের কাজের সুবিধার জন্য দুই নম্বর পুলিশ ফাঁড়ির ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ জমিসহ ভবন মালিককে বুঝিয়ে ওই জায়গাটি দান হিসেবে পুলিশের কাছে দলিল করে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া ফরিদপুর সদরের ধোপাডাঙ্গা চাঁদপুর এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির জন্য ৫০ শতাংশ জায়গা দিয়েছেন এক ধনাঢ্য ব্যাক্তি।

জেলা পুলিশ সদস্যদের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৪টি গাড়ির ব্যবস্থা করেন পুলিশ সুপার। এর মধ্যে দুটি মাইক্রোবাস, তিনটি টাটা লেগুনা, একটি প্রিজন ভ্যান ও ৮টি মাহেন্দ্র। এর ফলে পুলিশের উদ্যোগে ইজিবাইক, মাহেন্দ্র ও মাইক্রোবাস রিকুইজিশন নেওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

সেমি পাকা দশ শয্যার পুলিশ হাসপাতালকে ৫০ শয্যা পাকা ইমারত বিশিষ্ট পুলিশ হাসপাতাল করা হয়েছে। সেমি পাকা ওই হাসপাতাল ভবনটির প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার ৮২৮ টাকা।  সেটি উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে ১৯ গুণ বেশি দামে আট লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। পুলিশ কার্যালয় অধুনিকীকরণের জন্য তিনটি মেহগনি ও একটি নিম গাছ কাটার প্রয়োজন হয়। বন বিভাগ দাম নির্ধারণ করেছিল এক লাখ ১০ হাজার ৯৪৬ টাকা। সেটি উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে তিন লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।

ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শিপ্রা গোস্বামী বলেন, একজন জনবান্ধব পুলিশ সুপার বলতে যা বোঝায় তাই ছিলেন আলিমুজ্জামান। বদলি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমি অনেক পুলিশ সুপারকে চলে যেতে দেখেছি। আলিমুজ্জামানের জন্য ফরিদপুরের জনগণের মধ্যে যে কষ্ট দেখেছি, মনে হয়েছে তারা একজন আপনজনকে হারাচ্ছেন, এ অবস্থা আগে দেখিনি। ফরিদপুরের সর্বস্তরের লোককে এতটা অবলম্বনহীন হতে আগে দেখিনি।

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সভাপতি আওলাদ হোসেন বলেন, সবার জন্য পুলিশ সুপারের দরজা খোলা থাকায় যে কেউ অবাধে তার কাছে যেতে পারতেন,  বলতে পারতেন সমস্যার কথা, পেয়ে যেতেন সমাধান। এভাবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে একটি ভরসার নাম হয়ে উঠেছিলেন আলিমুজ্জামান। পুলিশ সুপার হিসেবে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম।

গতকাল মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) বিদায় অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান জেলায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা জনগণের সেবক। জনগণের জন্য আমাদের চাকরি। এই চাকরি করতে এসে আমাদের বিভিন্ন প্রকারের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। এক্ষেত্রে আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে- সততা। সততার সঙ্গে আমাদের চাকরি করতে হবে। তবেই আমরা জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারব। সত্যিকারেই আমরা মানবিক ও জনগণের সেবক হয়ে উঠতে পারব।

জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে নিজের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানুষের জন্য নানাবিধ কাজ করা যায়। আমি শুধু সেই কাজটিই করার চেষ্টা করেছি। 

জহির হোসেন/আরএআর