সকাল সাড়ে ১০টা। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার কুয়াদা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা সবাই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের পাঠদান শুনছে। ঠিক এমন সময়ে শোনা গেল ‘বাদাম লাগবে ভাই বাদাম, নেন না ভাই বাদাম’। এভাবেই দিন শুরু হয় ১২ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী কিশোর জুবায়ের আল-মাহমুদের।

তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবার পাশবিক অত্যাচারের কারণে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী জুবায়েরের ঠাঁই হয়েছে সদর উপজেলার সিরাজসিংঙ্গা গ্রামে নানাবাড়ির একটি জরাজীর্ণ কুটিরে। সেখানেই এক বছরের ছোট্ট একট বোনসহ দুই বোন, দুই ভাই আর মা রহিমা বেগমকে নিয়ে তার বসবাস। নিজে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হলেও বর্তমান শিক্ষিত সমাজে নিরক্ষর হয়ে থাকার ইচ্ছে তার নেই। তাই তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে ডহরসিংঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবে অভাবের কারণে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। কিছুটা বুঝতে শেখার পর মায়ের অভাবের সংসারে দুঃখ দূর করার জন্য স্কুল ব্যাগ ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছে বাদামের গামলা। 

এদিকে মা অসুস্থ থাকায় তিনি কাজ করতে পারেন না। তবে প্রতিদিন ভোরে ২-৩ কেজি বাদাম ভেজে দেন। সেই বাদাম বিক্রি করে যা লাভ হয়, তা দিয়ে কোনো মতো ডাল-চাল কিনে বাসায় ফেলে জুবায়ের।

চোখ মুছতে মুছতে জুবায়ের বলে, ‘আমি রাতে কোনো দিন খাইনে। রাতি খালি আমাগের সবার খাওয়া হয় না। তাই  মাঝে মাঝে যে অল্প দুটো ভাত থাকে, তাই সকালে পান্তা করে ঝাল আর পেঁয়াজ দিয়ে মাখে খাইয়ে বাদাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গেল কোরবানি ঈদের দিনও শাক দিয়ে ভাত খাইছি। পরে আশপাশের বাড়ি থেকে অল্প এট্টু গোস্ত চাইয়ে এনে রাতে মা রান্না করছিল।’

জুবায়েরের ছোট বড় যখন তার মায়ের পেটে, তখন তার বাবা তাদের ফেলে রেখে চলে যায়। তার বাবা আবার বিয়ে করেছেন। নড়াইলের ছাতিমতলার চাতালে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ওই ঘরেও তার একটা মেয়ে রয়েছে।  

সরেজমিনে জুবায়েরের বাড়িতে দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি টিনের ঘরে তাদের বসবাস। যেন একটু জোরে বাতাস হলেই ভেঙে পড়বে। এই ঘরেই চার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন মা রহিমা বেগম।  

রহিমা বেগম বলেন, ‘আমরা খুবই অসহায়। আমাদের সরকারিভাবে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করা হয় না। আমার এবং আমার প্রতিবন্ধী ছেলের কোনো কার্ড নেই। আগে আমার ছেলে জুবায়ের অন্যের দোকানে কাজ করত। তাতে প্রতিদিন ৩০-৪০ টাকা করে দিত। কিন্তুু জুবায়েরের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার রোগ আছে। ওর বয়স যখন ৩ মাস, তখন থেকে ওই রোগ। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনি। তাই দোকানে আর কাজে পাঠাই না। কিছু দিন ধরে বাদাম বিক্রি করছে। ওর বাদাম বেঁচা টাকা দিয়েই আধবেলা খেয়ে না খেয়ে আমাদের সংসার চলছে।

কুয়াদা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘এ ধরনের কিশোরদের জন্য অবশ্যই কিছু করা উচিত। সে আমার বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঘুরে-ঘুরে বাদাম বিক্রি করে। তার পরিবারের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগত। 

রামনগর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে জুবায়েরকে মাঝে-মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করি। তাদের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করাসহ পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।

যশোর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইতি সেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন অনলাইন জরিপ চলছে। প্রতিবন্ধী ওই শিশুকে সমাজসেবা অফিসে পাঠালে, তাকে একটা প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া যেতে পারে। ওই শিশুর মা স্বামী পরিত্যক্ত আর বয়স যেহেতু ৬০ হয়নি এবং নিজস্ব কোনো জায়গা-জমি নেই, তাই তাদের পরিবারের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেটা দেখব।

এসপি