‘ফুল ফুটলে হামারে ভালো। মাইনসে দূর-দূরান্ত থাকি দেখি যাইবে। সাথে হামরাও ফুল তুলি বেচাবার পামো। কয়দিন ধরি ভালোয় ফুল ফুটছে। সবায় খালি আইসে আর ছবি তোলে। কায়ো কায়ো তো হামার কাছ থাকি ফুলও কিনি নিয়্যা যাওছে।’এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ১২ বছরের কিশোর শরিফুল ও রিতা মনি। তারা কোমরপানিতে নেমে বেতানির বিল থেকে তুলে আনা শত শত পদ্মফুল বিক্রি করছে।

বেতানির বিল রংপুর মহানগর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে রংপুর-কুড়িগ্রাম সড়কের মীরবাগ ও কাউনিয়ার মাঝামাঝিতে অবস্থান। শহীদবাগ ইউনিয়নের হলদিবাড়ির কোলঘেঁষে বিলটির অবস্থান। কেউ কেউ বলেন হলদিয়ার বিল। মহাসড়কের দুই ধারে বেশ অনেকটা জায়গাজুড়ে ফুটে আছে পদ্ম। ছড়াচ্ছে মুগ্ধতা। গেল কয়েক বছর ধরে বিলটি ‌‘পদ্মফুলের অভয়ারণ্য’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বর্তমানে বিলজুড়ে পদ্মফুল ছেঁয়ে গেছে। সবুজের মাঝে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল সহজেই নাড়া দিচ্ছে মন। অনিন্দ্যসুন্দর এ দৃশ্য দেখতে অনেকেই আসছেন বেতানি বিলে। মনে দোলা দিয়ে যাওয়া পদ্মফুলের সমাহারে দর্শনার্থীরা যেমন উচ্ছ্বসিত, তেমনি আনন্দিত শরিফুল-রিতার মতো ফুলকুড়ানি শিশু-কিশোররাও।  

শরিফুল ও রিতা জানায়, প্রতিদিন তারা দুজন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সেখানে ২০০-৪০০ টাকার ফুল বিক্রি করে থাকে। বিলে ফুল ফুটলে তাদের দিন ভালো যায়। পদ্মফুল বিক্রি করে তাদের মতো আশপাশের অনেক শিশুরই স্কুলের খাতা, কলম ও জামা-কাপড় কিনতে সুবিধা হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জ সাতমাথা মোড় থেকে কাউনিয়া-কুড়িগ্রাম সড়ক ধরে কয়েক কিলোমিটার যেতেই চোখে পড়বে বিতানির বিল। এই বিলে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল আভা ছড়াচ্ছে দর্শনার্থীদের মনে। এখানে সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসছেন অনেকেই। কেউ কেউ সড়কের পাশে এই বিলের সবুজময় প্রকৃতি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। অনেকেই কলাগাছের ভেলায় করে পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যাচ্ছেন প্রকৃতির মাঝে।

পদ্মবিলপাড়ের বাসিন্দা আজম আলী জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে সেখানকার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেন। এলাকার কিছু শিশু এই বিলের ফুল বিক্রি করে তাদের পড়ালেখার খরচ যোগাচ্ছে। কেউ কেউ আবার ফুল বিক্রি করে পরিবারকে সহযোগিতা করছে। 

বিলজুড়ে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সাদা আর গোলাপি রঙের পদ্মফুল। বিলের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে প্রাকৃতিকভাবে এ পদ্মফুল জন্মে থাকে। এ কারণে পুরো বিল এখন গোলাপি আর সাদা রঙের পদ্মফুলে ভরা।

স্থানীয় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, পদ্মবিলের সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রতিদিনই বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকে এখানে ঘুরতে আসেন। যে যার মতো করে পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করেন আবার ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করে রাখেন। বর্তমানে বিলটি শুধু উপভোগের নয়, বরং অনেকের জীবিকা অর্জনের একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

রংপুর মহানগরী থেকে বিলে ঘুরতে আসা রেজাউল ইসলাম জীবন বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে পদ্মবিলে ঘুরতে আসি। এ বিলের সৌন্দর্য দেখার মতো। এখানে ঘুরতে আসলে মন ভালো হয়ে যায়। ফুলের সমারোহ আর এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ মনকে বিমোহিত করে তোলে।

পরিবার নিয়ে বিলেরপাড়ে ঘুরে এসেছেন রংপুরের বিশিষ্ট লেখক রানা মাসুদ। তিনি পদ্মফুলের সৌন্দর্য দেখে বলেন, সকালে লেখালেখির কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ খবর এলো বিতানির বিলে উজাড় করে পদ্ম ফুটেছে। মানুষ মহা উৎসাহে সে সময় পদ্মফুল তুলে শেষ করেছিল। আবার ফুটেছে, তাই দেরি না করে এবার চলে গেলাম। চলার পথে মানুষ বাইক অথবা গাড়ি থামিয়ে চোখ জুড়াচ্ছেন। স্থানীয় কিশোরের দল বেশ কসরত করে জলা থেকে সংগ্রহ করছে পদ্ম। পথের ধারেই বসছে তা বিক্রির জন্য। বেশ ভালো লাগার মতো জায়গা।

শহিদবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান বলেন, বিলটি প্রকৃতিগতভাবেই অনেক সুন্দর। তবে এটি নিয়ে এখনো তেমন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যান ও এমপি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখব কিছু করা যায় কি না।
 
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি