ময়মনসিংহে ঐতিহাসিক স্থাপনা আলেকজান্দ্রা ক্যাসল বা ‘লোহার কুঠি’ এবং সামনের খেলার মাঠ ঘিরে প্রাচীর তোলাকে কেন্দ্র করে বইছে সমালোচনার ঝড়। স্থাপনাটিকে প্রাচীর দিয়ে আড়াল করে দেওয়ার চেষ্টার প্রতিবাদ শুরু হলে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল কর্তৃপক্ষকে কাজটি বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। তবে এমন উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সুশীল সমাজ। সোমবার (২৯ আগস্ট) দুপুরে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করেছেন তারা।

যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রাচীর নয়, বিদ্যালয়ের সামনের সড়ক দিয়ে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করা ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে নিজস্ব অর্থায়নে ২৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৪ ফুট উচ্চতার নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভালো উদ্দেশ্যকে একটি মহল অন্যভাবে নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে বিব্রত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে।

ময়মনসিংহ জেলার শতবর্ষ উপলক্ষে মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সুকান্ত সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী শহরে উৎসব পালনের জন্য দ্বিতল এই ভবনটি নির্মাণ করেন। আবার কারও মতে, ময়মনসিংহের তৎকালীন ইংরেজ কালেক্টর আলেকজান্দ্রা নামে ১৮৭৯ সালে ভবনটি নির্মিত হয়। শুরুতে এটি মহারাজার বাগানবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এটি স্থানীয়দের কাছে ‘লোহার কুঠি’ নামেও পরিচিত। নগরীর বাতিরকল এলাকার লোহার কুঠিতে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের কার্যক্রম চললেও বছর দুয়েক আগে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে।

আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল বাগান বাড়িটিতে অন্তত আটটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই বাগান বাড়ির সীমানা প্রাচীরের মধ্যে অবস্থিত। দুই পাশের দুটি প্রবেশ পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাছাড়া প্রাচীন স্থাপনাটি দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীও আসেন। 

কিন্তু কয়েক দিন ধরে লোহার কুঠির সামনের অংশে প্রাচীর তোলার কাজ শুরু করে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল। প্রাচীন স্থাপনাটির সামনের খোলা মাঠটি ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রাত্যহিক সমাবেশ করতে অসুবিধা, বহিরাগত প্রবেশ, মেয়েদের নিরাপত্তা, নানা বিষয় সামনে এনে প্রাচীর তোলার কাজ শুরু করে স্কুলটি। ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ঘিরে প্রাচীর তোলার কাজ শুরু হওয়ায় সামাজিক যোগযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র অসন্তোষ শুরু হয়েছে।

পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহম্মেদ লিটন বলেন, ময়মনসিংহের মানুষ এতোটা বোকা নয়, যারা প্রাচীর নির্মাণ করে পরিবেশ বিনষ্টের পাশাপাশি অর্থ হাতানোর চিন্তা-ভাবনা করছেন, তাদের উদ্দেশ্য কখনো সফল হতে দেবে না। দ্রুত নির্মাণাধীন দেয়াল ভেঙে ইট-বালু সরাতে হবে। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সরাতে বাধ্য করাতে হবে।

জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন কালাম বলেন, চারপাশে বাউন্ডালি ওয়াল থাকা সত্ত্বেও ভেতরে আরেকটি প্রাচীর করে আমাদের ঐতিহ্য বিনষ্ট করার পায়তারা করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যকে কোনো অবস্থাতেই নষ্ট করতে দেবো না।

অনসাম্বল থিয়েটারের সভাপতি আবুল মনসুর বলেন, এমন ঘটনা আমার বিবেককে নাড়া দিয়েছে। একে তো আমাদের ঐহিত্যবাহী স্থাপনাগুলো ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, তার ওপর সেগুলো নানাভাবে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। আমরা চাই সরকারিভাবে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ হোক এবং কোনো গোষ্ঠীর দ্বারা কোনোভাবে যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, কারো সঙ্গে কোনো সমন্বয় না করে কীভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনার সামনে প্রাচীর নির্মাণ হয়? যে যার মতো একক সিদ্ধান্তে নিজের লাভের জন্য ময়মনসিংহকে ধ্বংস করছে। এই ভবনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ভেতরের সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে লোভনীয়। কিন্তু প্রাচীর নির্মাণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার জন্য কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে।

গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক তাপস মজুমদার বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ইটের দুই ফুট গাঁথুনি দিয়ে স্টিলের র‌্যাক বসিয়ে চার ফুট উঁচু ব্যারিকেডের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করি। প্রতিষ্ঠানটি আমাদের সকলের। যাদের ছেলে-মেয়েরা এখানে পড়াশোনা করে, তারাই শুধু নিরাপত্তার বিষয়টি বোঝেন। অন্যরা হয়তো সেটি না বুঝে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমরাও চাই না ঐতিহাসিক নিদর্শন আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের সৌন্দর্যহানি ঘটুক।

গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রাত্যহিক সমাবেশ করতে পারে না, বাইরের ছেলেরা আনাগোনা করে, মেয়েদের সমস্যা হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজনও মাঠে চলে আসে, মোটরসাইকেল চলে আসে- এসব কারণে ইটের গাঁথুনির ওপর চার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত স্টিলের পাইপ দিয়ে টানা দেওয়ার কাজটি শুরু করা হয়েছিল। কোনো প্রাচীর তোলা হচ্ছিল না। কিন্তু আমাদের ভালো উদ্দেশ্যকে একটি মহল অন্যভাবে নিয়ে বিব্রত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এক দিন কাজের পর গত বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। আমাদের স্কুলের মেয়েরা প্রতিনিয়ত বখাটেদের ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। যার জন্য এই উদ্যোগ আমাদের ছিল। এখন জেলা প্রশাসক যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তাই করব।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার বসে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রাচীর নির্মাণ না করে কীভাবে স্কুলের সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়, সেই চেষ্টা করব।

উবায়দুল হক/এসপি