‘ষোলো চাষে মুলা, তার অর্ধেকে তুলা, তার অর্ধেকে ধান, বিনা চাষে পান’-এটি একটি জনপ্রিয় খনার বচন। এর সরল অর্থ দাঁড়ায়- ১৬ দিন চাষের জমিতে ভালো ফলন দেয় মুলা। তুলার ভালো ফলন মেলে জমিতে ৮ দিন চাষ দিলে। ৪ দিন চাষের জমিতে ভালো ফলে ধান। আর পানের জমিতে চাষেরই প্রয়োজন হয় না। 

পরম্পরায় এ নিয়মেই চাষাবাদ করে আসছেন বরেন্দ্র খ্যাত রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা। কিন্তু এবার পাল্টে গেল চাষের কৌশল। পানের মতো এবারই প্রথম বরেন্দ্র অঞ্চলে বিনা চাষে আবাদ হচ্ছে ধান। শুধু তাই নয়, ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে বেডে।  

চলতি আমন মৌসুমে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলার ১২৬ জন কৃষক এই দুই পদ্ধতিতে আমন চাষ করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় ‘ক্লাইমেট স্মার্ট কনজারভেশন’ বা  ‘জলবায়ু সুসামঞ্জস্য’ কৃষি প্রযুক্তির এই চাষ জনপ্রিয় করতে কাজ করছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাজশাহী অঞ্চলিক কেন্দ্র।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরেন্দ্র এলাকায় সেচের পানি সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রলম্বিত হচ্ছে খরা। এই পরিস্থিতিতে এ দুটি কৃষি কৌশল ৫০ ভাগ সেচ সাশ্রয় করবে। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করবে। সুরক্ষিত থাকবে পরিবেশ। বাড়বে ফসলের নিবিড়তা এবং উৎপাদন। সব মিলিয়ে কৃষকের লাভের অংক বাড়বে।

কৃষকরা বলছেন, মূলত বেড পদ্ধতিতে ধান ভালো হয় আমন মৌসুমে। আর শূন্য চাষ বা বিনা চাষ বোরো মৌসুমের জন্য ভালো। এই দুই পদ্ধতিতে চাষে প্রচলিত পদ্ধতির মতো ধানের আগে একটি এবং পরে একটি করে ফসল তোলা যাচ্ছে। এই দুই পদ্ধতিতে ধানের ফলনও ভালো।

গোদাগাড়ীর বিজয়নগরে বিনা চাষে এবং বেড পদ্ধতিতে ধান চাষ করেছেন কৃষক সাব্বির হোসেন। তিনি জানান, বেড পদ্ধতিতে তিনি বেড প্ল্যান্টার মেশিনের সাহায্যে জমিতে একটি মাত্র চাষ দিয়েছেন। এরপর জমিতে পানি সেচ দিয়েছেন। এর তিন থেকে চার দিন পর জমিতে ধানের চারা রোপণ করেছেন। এতে তার চাষের খরচ বাঁচল। এক সেচেই ধানের চারা রোপণ করা গেছে।  

অন্যদিকে বিনা চাষে ধান আবাদের জন্য জমিতে চাষের প্রয়োজন পড়ে না। চারা রোপণের সাত দিন আগে জমিতে আগাছানাশক দিয়েছেন। এর তিন দিন পর দিয়েছেন সেচ। এর ফলে মাটি নরম হয়ে গেছে। সেচ দেওয়ার দুই দিন পর নরম মাটিতে ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে।

এই কৃষক বলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে এক বিঘা জমি প্রস্তুত করতে খরচ হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। তবে বেড পদ্ধতিতে এই খরচ মাত্র ৬০০ টাকা। আর বিনা চাষ পদ্ধতিতে চাষের খরচ নেই। কেবল ৪০০ টাকার আগাছানাশক প্রয়োগ করা হয়েছে। এই দুটি পদ্ধতি সেচ সাশ্রয়ী। শ্রমিক খরচও বাঁচায়। মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকায় ধানের ফলন বাড়ে। সব দিক দিয়ে বিঘায় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভ হবে কৃষকের।

পুরো কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছেন বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক প্রধান ড. ইলিয়াছ হোসেন। তিনি বলেন, রাজশাহী অঞ্চল খরা প্রবণ। এই অঞ্চলে সেচের পানির ঘাটতি রয়েছে। কেবল পানির অভাবে আমন মৌসুমে ৭৫ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। এই জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব হলে অতিরিক্ত প্রায় ৩০ টন ফসল ফলানো সম্ভব। তাতে বাড়তি জনগোষ্ঠীর জন্য খাবারের যোগান দেওয়া যাবে। 

ক্লাইমেট স্মার্ট কনজারভেশন বা জলবায়ু সুসামঞ্জস্য কৃষি প্রযুক্তি প্রসঙ্গে এই গবেষক বলেন, এই প্রযুক্তির  লক্ষ্য জমিতে কম চাষ দেওয়া। যাতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। শস্য পর্যায় থাকতে হবে। অন্তত তিনটা ফসল চাষ করতে হবে। এতে ফসলের নিবিড়তা বাড়বে। জমিতে খড় বা নাড়া রাখতে হবে। এতে জমির উর্বতা শক্তি বাড়বে।

তিনি বলেন, ধান উৎপাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন। আর এই অঞ্চলে সেচের পানির সংকট। বিষয়টি মাথায় রেখে কৃষকদের আমন মৌসুমে ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ধানের পর পর্যায়ক্রমে গম, সরিষা, ভুট্টা, মুগডাল, তিল প্রভৃতি চাষ করা যায়। এতে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি সেচের পানির সাশ্রয় হবে। 

ড. ইলিয়াছ হোসেন আরও বলেন, যে জমিতে পানি দিলে মাটি নরম হয়ে যায়, সেইসব জমিতে বিনা চাষে ধান রোপণ করা যাবে। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে এই পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর। আবার আমন মৌসুমে কার্যকর বেড পদ্ধতিতে ধান চাষ।  

যেসব জমি জলাবদ্ধ থাকে, সেই জমিতে বেড পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। এতে জলাবদ্ধতায় ফসলের ক্ষতির শঙ্কা থাকে না। সহজে গাছ হেলেও পড়ে না। ইঁদুরের উপদ্রব থাকে না। ফসল পরিচর্যায় সুবিধা হয়। তাছাড়া পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও পুষ্টি পাওয়ায় ফসলের দানা পুষ্ট হয়। 

এ বিষয়ে রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম জানান, এই জমি আমাদের যোগ্য করে রাখতে হবে। উৎপাদনমুখী করে রাখতে হবে। বারবার জমি চাষ এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহারে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। এ ক্ষেত্রে সমাধান বিনা চাষে ফসল উৎপাদন। এই প্রক্রিয়াটি কৃষকরা গ্রহণ করেছেন। 

তিনি আরও বলেন, বরেন্দ্রভূমিতে বেড প্লাটারে গম-সরিষা চাষ হয়েছে। এখন ধান রোপণ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে ধান চাষ হলে জমির গুণগত মান ঠিক থাকবে। রোগবালাই দূরে থাকবে। ফলনও ভালো হবে। আমরা কৃষকদের এই কলাকৌশলগুলো জানাচ্ছি, দেখাচ্ছি এবং বোঝাচ্ছি। যাতে তারা তারা এগিয়ে আসেন। 

সম্প্রতি গোদাগাড়ীর বিজয়নগর ও পবার খোলাবোনা এলাকার ধানক্ষেত ঘুরে গেছেন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) জলবায়ু ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক সিনিয়র স্পেশালিস্ট ড. মেনোয়ার করিম খান। তিনি বলেন, বিনা চাষে কী করে ফসল উৎপাদন করা যায়, ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো যায়, আমরা সেটি দেখতে এসেছি। আগে আমরা শুনতান বিনা চাষে অন্য ফসল হচ্ছে। কিন্তু বিনা চাষে ধান উৎপাদনের কথা কখনো শুনিনি। এবারই প্রথম সচক্ষে তা দেখলাম। 

তিনি বলেন, বিনা চাষে আবাদে জমি চাষের খরচ লাগছে না। মাটি চাষ করা না লাগলে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে না। পরিবেশের ক্ষতিও কম হচ্ছে। আমরা ফলনও বেশি পাচ্ছি। আর বেড পদ্ধতিতে ধান চাষে খরচ কম, শ্রমিক ও সার লাগছে কম। কীটনাশক লাগছে কম। ইদুরের উপক্রম কম হওয়ায় ফসলের ক্ষতিও কম। এতে সার্বিকভাবে ফসলের উৎপাদন বাড়বে। চাষিরা লাভবান হবেন। 

রাজশাহী অঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আউশ, আমন ও বোরো মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে মোট ৯ লাখ ৪০ হাজার ৫৩১ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়েছে। এ থেকে ফলন হয়েছে ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৩২৮ টন ধান। এক যুগ আগে ২০১১-১২ মৌসুমে এই চার জেলায় ১০ লাখ ৫ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়েছিল। ওই বছর কৃষক গোলায় তুলেছিলেন ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৪৩ টন ধান।

আরএআর