‘প্রায় ২৬ বছর আগে মাদকাসক্ত স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এরপর দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বাবার বাসায় চলে আসি। ১৬-১৭ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ায় স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর তখনো অনেক বিয়ে এসেছিল। শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করিনি। অন্যের বাড়িতে কাজ করে করে ছেলেমেয়েদের বড় করেছি, বিয়ে দিয়েছি। দুই মেয়ে থাকে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলের বাসায় থাকলেও আমার ভরণপোষণ দেয় না। এমনকি বউয়ের সঙ্গে নানারকম ঝামেলা লেগেই থাকতো। তবে অশান্তি থেকে এখন রক্ষা পেয়েছি। খেয়ে বা না খেয়ে থাকি, কিন্তু অনেক শান্তিতে বসবাস করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহারের ঘরে।’

কথাগুলো বলছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামের বাসিন্দা সেফালী বেগম (৫২)। ছয় মাস আগে তার নতুন ঠিকানা হয়েছে চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে। 

শুধু সেফালী বেগম নয়, এখানে একই জায়গায় পাশাপাশি আশ্রয় হয়েছে অসহায়, হতদরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা, ভূমিহীন ও প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক ১১টি পরিবারের। প্রতিটি ঘর একই ধরনের। যেখানে রয়েছে, দুটি শোবার ঘর, টয়লেট, রান্নাঘর ও বারান্দা। 

১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় সেফালী বেগমের। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের হুজরাপুর এলাকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে সংসার করেন প্রায় ১০ বছর। মাদকাসক্ত স্বামীকে সংসারে মনযোগী করতে রিকশা ভাড়া করে দিলেও তা নিয় পালিয়ে যান। সংসারের থালাবাসন পর্যন্ত বিক্রি করে মাদক সেবন করতেন দেলোয়ার হোসেন। বাধ্য হয়েই তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। 

শুরু হয় নতুন করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংগ্রাম। পরিবার থেকে বারবার বিয়ে দিতে চাইলেও তাতে রাজি হননি সেফালী বেগম। অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলেমেয়েদের বড় করে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে রিপন আলী এখন অটোরাইস মিলে শ্রমিকের কাজ করেন। একই বাড়িতে বসবাস করলেও সেফালী বেগমের সংসার ছিল আলাদা। মানুষের বাড়িতে কাজ করে যা পেতেন, তাই দিয়ে চলতেন। 

সেফালী বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৬ মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে উঠেছি। ছেলের প্রথম বউয়ের এক নাতি ছিল। তাকে নিয়েই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে থাকি। এখন মানুষের বাড়িতে কাজ করি। এতে যা পায় তাতেই সুখে আছি। কারণ মাথার গোঁজার একটা স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছি। 

গত ৫০ বছর ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালত চত্বরে ভিক্ষা করে জীবন চলে ভূমিহীন রাবিয়া বেগমের (৬৫)। দৃষ্টিশক্তিহীন রাবিয়া বেগমের কোনো জায়গা ছিল না। বাধ্য হয়েই রেলস্টেশনের পাশে একটু ঘরভাড়া করে বাস করতেন। রাবিয়া বেগমও পেয়েছেন চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রথম ঘরটি। এক নাতিকে নিয়ে সেখানেই বসবাস করছেন ১৪ বছর বয়সে টাইফয়েডে দৃষ্টিশক্তি হারানো রাবিয়া। 

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২১ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। ভিক্ষা করেই ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করিয়েছি। সেই ছেলে এখন তার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বসবাস করে। আমি এক নাতিকে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াই। মানুষের কাছেই চেয়ে খাই। আমি দুই চোখে কিছুই দেখি না। নাতি রাব্বি (১১) আমাকে ধরে ধরে মানুষের দ্বারে দ্বারে নিয়ে যায়। ৩ মাস বয়স তার মা তাকে রেখে চলে যায়। এরপর বাবা আরেকটা বিয়ে করলে এখন আমি ছাড়া তার আর কেউ নেই।

তিনি আরও বলেন, শেষ বয়সে এসে হলেও একটা ঘর পেয়েছি। আমাদের মতো মানুষের জন্য ঠিকানা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমার সৌভাগ্য, বেঁচে থাকতে থাকতে শেখ হাসিনার মতো প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি। তার এই অবদানেই আল্লাহ তাকে ও তার পরিবারকে সুস্থতা ও জান্নাত দান করবেন, ইনশাআল্লাহ৷ 

রাবিয়ার নাতি রাব্বি বলে, আমি জেলা শহরের পাঠানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। পরে করোনায় স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে আর স্কুলে যায়নি। এখন দাদিকে পথ দেখানোর কাজ করি। অনেক জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের একটা স্থায়ী ঘর হয়েছে, জমি হয়েছে। আমি ছোট, অন্যদিকে দাদি চোখে দেখতে পায় না। তাই রান্নাও করতে পারি না। ভিক্ষা করতে গিয়ে চেয়ে খেয়ে দিন পার করি। 

বড় বোন রাজিয়া বেগম ৮-৯ বছর ধরে ও ছোট বোন স্বামী পরিত্যক্তা সেরিনা বেগম ভূমিহীন ভাইয়ের বাড়িতে ১০ বছর ধরে বাস করতেন। ছোট বোন সেরিনা বেগম পেয়েছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। সেখানেই গত ৬ মাস ধরে বড় বোনকে নিয়ে বাস করেন সেরিনা। 

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সেলাই মেশিনের কাজ করে নিজের সংসার চালাই। কিন্তু এতোদিন দুই বোনকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কারণ ভূমিহীন ও রাস্তার পাশে খাস জমিতে বসবাস করা ভাইয়ের ছেলেমেয়ে ও পরিবার নিয়ে এমনিতেই সেখানে থাকতে হিমশিম খেতে হতো। সেখানে ঘরে পানি পড়ত, থাকতে কষ্ট হতো। কোনো দিন কল্পনাও করতে পারিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াবেন। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছি, এখন অনেক ভালো আছি, সুখেই আছি। 

চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামের লক্ষণ ঘোষের মেয়ে মৌসুমী ঘোষের স্বামী কিডনি নষ্ট হয়ে মারা যান ২০১৪ সালে। এরপর থেকেই এক মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে বসবাস করতেন মৌসুমী। উপহারের ঘর পাওয়া মৌসুমী ঘোষ বলেন, আমার স্বামী ছিলেন ভূমিহীন দরিদ্র। শ্বশুর-শাশুড়িও বেঁচে ছিলেন না। তাই বাধ্য হয়েই বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিই। কিন্তু হিন্দু রীতি অনুসারে মেয়েরা বাবার বাড়ি থেকে বিয়ের পর আর কোনো সম্পদের ভাগ পায় না। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সাহায্যেই চলছে আমাদের সংসার। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, ছোট ছেলে চাঁপাই-মহেশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। আমার কথা বাদই দিলাম, ছেলের জন্য হলেও থাকার একটা স্থায়ী জায়গা পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের জন্য যা করেছেন, এর চেয়ে আর ভালো কাজ হয় না। তিনি আমাদেরকে দেখেননি, আমরা তাকে দেখিনি। কিন্তু তারপরও আমাদের জন্য তার এই অবদান কেনোদিন ভুলার নয়। ভগবান তাকে ভালো রাখুক। থাকার জায়গা হয়েছে, যেভাবেই হোক এখন আমরা ভালো আছি। 

গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান মো. তাসেম আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের জায়গাটি সরকারি জমি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অন্যের দখলে ছিল। পরে প্রশাসন ও ভূমি অফিস দখলকৃত জমি থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করে সেখানে উপহারের ঘর তৈরি করা হয়েছে। আশ্রয়ণহীন, ভূমিহীনরা ঘর পেয়েছেন। সরকারের উদ্যোগটি প্রশংসার দাবি রাখে। 

ইউপি সদস্য রাফেজ মীর জানান, চাঁপাই-মহেশপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের সারিবদ্ধ ঘরে ১১টি পরিবার বসবাস করছে। সব ধরনের সরকারি সহায়তায় তাদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।  

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফফাত জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজের শুরু হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। বর্তমানে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর কাজ চলমান রয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর একান্ত নিজের ও আবেগের বিষয়। সেই আবেগ নিয়েই আমরা মাঠপর্যায়ে কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ছিল, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের কোনো ভূমিহীন ঘর ছাড়া থাকবে না। সেই স্বপ্ন পূরণে আমরা সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে কাজের তদারকি করছি। 

তিনি আরও বলেন, যাদের মাথা গোঁজার জায়গা ছিল না, তারা যখন তাদের কাঙ্খিত আবাসস্থল পাচ্ছে, তখন অন্য কাজে মনোনিবেশ করতে পারছে। নানা আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছে। নিজেদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাচ্ছে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিজেদেরকে এগিয়ে নিচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, চতুর্থ দফায় আরও ৯১টি ঘরের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। এই ঘরগুলো সুবিধাভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করা হলেই সদর উপজেলাকে শতভাগ গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হবে। 

উল্লেখ্য, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় মিলে ৪৫৫৪টি পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১৩১৯টি ও দ্বিতীয় পর্যায়ে জেলার পাঁচ উপজেলায় ২৬১৯টি গৃহহীন পরিবারের নিকট জমিসহ ঘর হস্তান্তর করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে আরও ৬১৬টি পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়। তৃতীয় পর্যায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় ৭১টি, শিবগঞ্জে ১১৬টি, গোমস্তাপুরে ৬৩টি, নাচোলে ২১৬টি ও ভোলাহাট উপজেলায় ১৫০টি মিলে মোট ৬১৬টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

জাহাঙ্গীর আলম/আরএআর