রংপুরে আড়াই বছর আগে বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে পড়ে বদরগঞ্জের ধোধড়া শাখা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি। এরপর আর সেতুর ভঙ্গুর দশার কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্থানীয়রা ভাঙা সেতুর সঙ্গে বাঁশের সাঁকোর সংযোগ গড়েছেন। সেই সাঁকো দিয়ে পারাপার যেমন দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি বেড়েছে দুর্ভোগও।

সেতুটি সংস্কারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিদের কাছে বহুবার ধরনা দিয়েছেন স্থানীয়রা। কিন্তু আশ্বাসের বেড়াজালে মনে তৈরি হওয়া বিশ্বাসে এখন চিড় ধরেছে। সঙ্গে ১৫-২০ মিনিটের রাস্তা যেতে এখন স্থানীয়দের সময় লাগছে ঘণ্টা দেড়েক। বর্তমানে নড়বড়ে সাঁকো হয়ে উৎপাদিত ফসল নিয়ে হাটে যেতে পারছেন না কৃষকরা। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে তাদের ১৫ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হচ্ছে হাটবাজারে।  

এই দুর্ভোগ শুধু কৃষক কিংবা সাধারণ মানুষের নয়। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ ছয়টি গ্রামের অন্তত ১৫ হাজার মানুষ এখন সেতু ভাঙায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। দ্রুত ভাঙা সেতুর সংস্কার, নয়তো নতুন করে সেতু নির্মাণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ সংসদ সদস্যের প্রতি আকুতি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বদরগঞ্জ উপজেলার রাধানগর ইউনিয়ন পরিষদের কুঠিয়ালপাড়া, হাজীপাড়া, ডাঙাপাড়া, পাটোয়ারীপাড়া, দিলালপুর ও বিন্দিরধর গ্রামের অন্তত ১৫ হাজার মানুষ ধোধড়া শাখা নদীর ওপর নির্মিত সেতুর ওপর দিয়ে উপজেলা সদরে যাতায়াত করতেন। গ্রামগুলোর তিন শতাধিক শিক্ষার্থী সেতু পেরিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করত। কিন্তু ২০১৯ সালের বন্যায় সেতুটি ভেঙে পড়ার পর থেকে তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই।

বর্তমানে স্থানীয়রা ভাঙা সেতুর সঙ্গে সংযোগ হিসেবে বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করে যাতায়াত করছেন। শুধু বদরগঞ্জের রাধানগর ইউনিয়নের লোকজনই নয়, এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী তারাগঞ্জ উপজেলা, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর এবং দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার লোকেরাও সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করছেন। হেঁটে সাঁকো পারাপার হওয়ার পাশাপাশি অনেকেই অটোরিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল নিয়ে চলাচল করছেন।

সম্প্রতি পারাপারের সময় ওই বাঁশের সাঁকোর ওপর থেকে এক পথচারী নিচে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন বলে জানান কয়েকজন গ্রামবাসী। পাঠানের হাটের পাশেই ধোধড়া শাখা নদীর (পচানালা নদী) ওপরে নির্মিত সেতুটির আংশিক ভেঙে পড়ার পর থেকে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে দাবি করে স্থানীয় ভ্যানচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, এই সেতু যে মেলা দিন থাকি ভাঙ্গি পড়ি আছে, তা সবাই জানে। সেতুটা কেউ দেখপারও আইসে নাই। হামার ইলার দুঃখ কষ্ট কেউ বোঝে না। মনে হয় হামরা দ্যাশের মানুষ নোয়াই।

লালদিঘী ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মনির ইসলাম বলে, বাঁশের সাঁকোর ওপরে উঠলেই ভয় লাগে। বুকটা মাঝেমধ্যে কাঁপে। সে কারণে কখনো কখনো কলেজ যাই না। সেতুটা ভালো থাকলে ১০ মিনিটের মধ্যে কলেজে যেতে পারতাম। কিন্তু নড়বড়ে সাঁকোর কারণে এখন রাস্তা ঘুরে কলেজ যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা।

সেখানকার কুঠিয়ালপাড়া গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মমিনা খাতুন বলেন, সেতুটি দুই-তিন বছর আগে ভেঙে পড়ে।এখন পর্যন্ত সংস্কার করা হয়নি। আমি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। ঈদের ছুটিতে বা অন্য কোনো প্রয়োজনে গ্রামে এলে আমাকে ভেঙে পড়া সেতুর কাছে নেমে অন্তত আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে বাড়ি পৌঁছাতে হয়।

ডাঙাপাড়া গ্রামের রিকশাচালক জহর আলী বলেন, খালি শুনি কাম হইবে। সেতুর কাম তো দূরের কথা, আইজ পর্যন্ত সাঁকোটাও সরকারের লোকেরা একটা বাঁশ দিয়্যা মেরামত করি দেয় নাই। সাঁকোত উঠলেই মনে হয় এই বুঝি ভাঙি পড়ে। প্রতিদিন রিকশা ঠেলি পারাপার করা নাগে। কায়ো তো কোনো কাম করে না। ওই তকনে জীবনের ঝুঁকি নিয়্যা চলাচল করা নাগে।

দিলালপুর গ্রামের কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, কাঁয় হামার দুঃখ কষ্ট কায় বুঝবে? সগায় থাকে ভোট নেয়ার আশাত। আড়াই বছর ধরি শোনোছি সেতুটার কাম হইবে। কিন্তু আইজ পর্যন্ত কাঁয়ো কিছু করিল না। এ্যলা হামলা আশা ছাড়ি দিছি। কপালোত যা আছে, তাকে হইবে। এই সেতুর জনতে হামরা ক্ষতিগ্রস্ত। হামরা ফসল আবাদ করিয়া হাটোত নিয়া বেচপার পারি না। গ্রামোতে কম দামোত বেচে দিবার নাগে। হামার গ্রামের মানুষের কষ্টটা কাঁয়ো দ্যাকে না বাহে।

রাধানগর ইউনিয়নের অনেকের সঙ্গে ভাঙা সেতু নিয়ে কথা হয়। তাদের ভাষ্য মতে, প্রতিদিন ওই ভাঙা সেতু লাগোয়া ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে পাঠানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠানপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, লালদিঘী ও/এ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, লালদিঘী পীরপাল ডিগ্রি কলেজ, বদরগঞ্জ মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, বদরগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বদরগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও বদরগঞ্জ সরকারি ডিগ্রি কলেজের শত শত শিক্ষার্থী যাওয়া-আসা করেন। এছাড়া ওই ইউনিয়নের অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করা নিয়ে ভোগান্তিতে থাকেন। সাঁকোটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াতে কেউ কেউ ফসল নিয়ে বিকল্প রাস্তা দিয়ে অন্তত ১৫ কিলোমিটার ঘুরে হাটবাজারে যান। এতে ২০ মিনিটের রাস্তা যেতে এখন ওই এলাকার মানুষের সময় লাগছে ঘণ্টা দেড়েক।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শুধু সেতুটি নির্মাণে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। কিন্তু কেউই সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে রাধানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিকের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বদরগঞ্জ উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বাপ্পী বলেন, ধোধড়া শাখা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি সংস্কার বা নতুন করে নির্মাণের জন্য খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র রায় জানান, তারা দ্রুত ওই সেতুটি নির্মাণের জন্য চেষ্টা করেছেন। এজন্য ইতোমধ্যে এলজিইডি অফিসে লিখিতভাবে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন তিনি।

বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ জানান, ভাঙা সেতুর স্থানে নতুন করে সেতু নির্মাণে এলজিইডি থেকে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করছি চলতি অর্থ-বছরেই সেতুটির কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। আমরা জনদুর্ভোগ লাঘবে চেষ্টা করছি। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি