কেউ তবলায় সুর তুলছে আবার অনেকে একসঙ্গে গলা ছেড়ে গাইছে গান। কেউ কেউ পেন্সিলে আঁকা ছবিতে রং করছে, আবার পায়ে ঝুমুর পড়ে নৃত্য করছে একদল শিশু। নারায়ণগঞ্জ শিশু একাডেমির ভেতরের চিত্র এমন হলেও বাইরের চিত্র খুবই আতঙ্ক ও উদ্বেগের।

নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় বঙ্গবন্ধু সড়কের ১৫৭ নং জরাজীর্ণ তিনতলা ঝুকিপূর্ণ ভবনটি মূলত নারায়ণগঞ্জ প্রিপারেটরি স্কুলের। নিজেদের নতুন ভবন নির্মাণের পর পুরোনো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ছেড়ে যায় স্কুল প্রশাসন। আর নিজেদের ভবন না থাকায় জেলা প্রশাসন থেকে ভবনটি ব্যবহার করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ শিশু একাডেমিকে। তবে ভবনটি তাদের অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। শহরের কোথাও এমন খোলামেলা ও বড় স্থান না পাওয়ায় সেখানেই এর সব কার্যক্রম চলছে নিয়মিত।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি বা শিশু একাডেমি দেশের শিশুদের একমাত্র জাতীয় একাডেমি। যা দেশের প্রত্যেকটি জেলার শিশুদের স্বল্প খরচে প্রতিভা বিকাশ ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধনে কাজ করে। তবে দেশের সবচেয়ে ধনী জেলায় শিশু একাডেমির জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি যেন একবারেই বেমানান।

১৯৯৪ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলায় সরকারি তোলারাম কলেজের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে শিশু একাডেমি। এরপর সেখানে জায়গা না হওয়ায় ২০ বছর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত নারায়ণগঞ্জ প্রিপারেটরি স্কুলের পুরোনো একটি ভবনের (বি.বি.রোডের ১৫৭ নং ভবন) দ্বিতীয় তলায় পরবর্তী যাত্রা শুরু করে। এদিকে প্রিপারেটরি স্কুল প্রশাসন ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নতুন ভবনে চলে যায়।

গত ২০ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ জেলা শিশু একাডেমির নিজস্ব ভবন বরাদ্দ না পাওয়ায় ঝুঁকি নিয়েইে পরিত্যক্ত ভবনে নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জমি বরাদ্দ হলেও জমির বেশ কিছু জটিলতার কারণে নির্মাণকাজ হচ্ছে না। ফলে প্রিপারেটরি স্কুলের পরিত্যক্ত ভবনে ঝুঁকি নিয়েই চলছে জেলা শিশু একাডেমির নিয়মিত কার্যক্রম।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির কোনো অংশে জন্ম নিয়েছে বৃহৎ আকারেরর বটবৃক্ষ, কোথাও দেয়ালের পলেস্তারা খোসে পড়েছে, বেলকনির ঢালাই করা কংক্রিট খুলে বেরিয়ে আছে লোহার রড। এরই মধ্যে ওই ভবনের তৃতীয় তলা বহু আগেই ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। তবে দ্বিতীয় তলায় নিয়মিত পাঠদান করছেন নারায়ণগঞ্জ শিশু একাডেমি। করোনার কারণে শিক্ষার্থী কিছুটা কমে গেলেও এ বছর ৯টি ইউনিটে সপ্তাহে পাঁচ দিন করে বিভিন্ন শিফটে  ক্লাস করতে আসে ৪৮০ জন শিক্ষার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ শিশু একাডেমিতে প্রতি বছরই ৮-৯শ শিশু ভর্তি হয়। তবে করোনা মহামারিতে যা অর্ধেকে নেমে ৪৮০ জনে গিয়ে ঠেকেছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রতি সপ্তাহে ২-৩ দিন ক্লাসে আসতে হয়। আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য, চিত্রাংকন, তবলা, গিটার, কম্পিউটার, সুন্দর হাতের লেখা ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নিয়মিত পাঠদানসহ মোট ৯টি শাখায় নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিযুক্ত আছেন ৪ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ১৪ জন শিক্ষক ও প্রশিক্ষক। শিশু একাডেমিতে নিজ সন্তানদের জন্য সেখানে অপেক্ষায় থাকেন আরও অন্তত ৫০ জন অভিভাবক। 

নগরীর আমলাপাড়া আদর্শ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বর্গেশ্রী সাহার বাবা সুশান্ত কুমার সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভবনটি আসলে এতটাই পুরোনো যে, বলা যায় অনেকটা পরিত্যক্ত ভবন। এখানে শুধু আমার বাচ্চা না, অনেক বাচ্চা নিয়মিত আসছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা হয়, তখন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উপস্থিতি হয় ব্যাপক। আমাদের দেশের যে পরিস্থিতি আসলে আমরা খুব আতঙ্কে থাকি। ভালো একটা পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে, নতুন একটা ভবন হলে আমরা আতঙ্কমুক্ত হই। পাশাপাশি বাচ্চাদেরও মন-মানসিকতা ভালো থাকে।

শিশু একাডেমিতে গান শিখতে আসা নিধি মজুমদারের মা শ্রাবণী মজুমদারের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে শ্রেণিকক্ষের যথেষ্ট সংকট রয়েছে। একটি ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য বিষয়ে ক্লাস করতে আসা শিক্ষার্থীদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। শ্রেণিকক্ষ বাড়ালে আর এই সমস্যটা হয় না। এছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে আসা অভিভাবকদের বসার জন্য নেই কেনো ব্যবস্থা। ঝুঁকি জেনেও এখানে কেন আসেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি হওয়ায় সুযোগ-সুবিধা বেশি। আর তাছাড়া বাচ্চারা নতুন কিছু শিখতে পারে, তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই এখানে আসা। আমরা চাই দ্রুত যেন শিশু একাডেমির নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়।

জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা ইসরাত জাহানের সঙ্গে কথা হলে তিনি ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ স্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভবনটি যেহেতু শতবর্ষী পুরোনো, তাই যেকোনো সময় দুর্ঘটনা হতেই পারে। আমরা বাচ্চাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পারি সেই চেষ্টায় আছি। ইতোমধ্যে আমাদের সয়েল টেস্ট থেকে শুরু করে নকশা প্রণয়নসহ ভবন নির্মাণের আনুষঙ্গিক সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু বাজেট বরাদ্দের অপেক্ষা। এই বিষয়ে আমাদের ডিজি মহোদয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সব তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এসপি