সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ

বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) পঙ্কজ দেবনাথকে আওয়ামী লীগের সকল পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে হিজলায় মিছিল করে মিষ্টি বিতরণ করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তবে ঠিক কোন অভিযোগ আমলে নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড এমপি পঙ্কজ দেবনাথের বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা স্পষ্ট নয়। 

অব্যাহতির মূল কারণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না খোদ পঙ্কজ দেবনাথও। তবে জেলা আওয়ামী লীগ মনে করছে, এমপি পঙ্কজ দেবনাথ অসংখ্য ‘অপকর্মের’ সঙ্গে জড়িত। যা স্থানীয় আওয়ামী লীগের চেয়েও কেন্দ্র বেশি জানে। কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তে বরিশাল আওয়ামী লীগে স্বস্তি ফিরে এসেছে। 

পঙ্কজ দেবনাথ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে দায়িত্ব পান কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদকের। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতও হয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর তিন বছরের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন বিতর্কে। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা অভিযোগ করেন, দলীয় নেতা-কর্মীকে নির্যাতন, দলে কোন্দল সৃষ্টি করা, দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পত্তি অর্জন, আলোচনায় থাকতে বাসে অগ্নিসংযোগ, এমনকি হত্যাও হয়েছে তার মদদে। বিভিন্ন সময়ে এসব অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তার অব্যাহতির খবরে এসব আবার নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

দলীয় কর্মীকে পঙ্গু করা

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার কাজিরহাট থানা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সঞ্জয় চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমপি পঙ্কজ দেবনাথের ভাইয়ের স্ত্রীসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করায় আমাকে তিন দফা নির্যাতন চালিয়ে হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দিয়েছে। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ মামলাটি করেছিলাম। এতে এমপি ক্ষিপ্ত হয়ে তার লোক দিয়ে ওই বছরের ২০ এপ্রিল নির্যাতন চালিয়ে আমার দুই পা ও একটি হাত ভেঙে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ছিনতাই মামলা দিয়ে কোর্টে চালান দেন। তার পরের বছর ২০১৮ সালের ১২ জুন আমাকে নতুন ডাক বাংলোতে ধরে নিয়ে মারধর করে বস্তা ভরে নদীতে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় আমি পঙ্কজ দেবনাথকে ১ নম্বর আসামি করে মামলাও করেছি। এরপর তারা ২০২০ সালে আবার আমাকে মারধর করে এলাকা ছাড়া করেন। 

সঞ্জয় চন্দ্র বলেন, আমার অপরাধ ছিল সংসদ সদস্যের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম। শুধু আমি না হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জের অনেক লোককে তিনি তার লোক দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে পঙ্গু করেছেন।

১১ জনকে হত্যার অভিযোগ

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও বরিশাল জেলা পরিষদের প্রশাসক মইদুল ইসলাম ২০১৭ সালের ২৩ মে জেলা পরিষদ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগে নিজের মালিকানাধীন বিহঙ্গ পরিবহনে তার (পঙ্কজ দেবনাথ) মদদে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এতে বাসের চালকসহ ১১ জন নিহত হন। 

মইদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, পঙ্কজ দেবনাথ হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট নেতা। তিনি আওয়ামী লীগ সহ্য করতে পারেন না। এজন্য এলাকায় দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্যাতন চালান।  

মেয়রকে কোপানোর নির্দেশ

মেহেন্দীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল খানকে কোপানোর নির্দেশ দেওয়ার একটি অডিও ক্লিপ গত জুলাই মাসে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছরের ৫ জুলাই দলীয় নেতা-কর্মীদের এই নির্দেশ দেন- এমন তথ্য জানিয়ে পঙ্কজ দেবনাথ মেহেন্দীগঞ্জ থানার পুলিশ পরির্দশক তৌহিদুজ্জামানকে মুঠোফোনে অবহিত করছিলেন। সেই অডিও ক্লিপটি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করে। কথোপকথনের অডিও ক্লিপটি তার নিজের বলে স্বীকার করে নেন পঙ্কজ দেবনাথ।

অঢেল সম্পত্তির মালিক

পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চর দখল করে নিজের আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, গোডাউন সিন্ডিকেট, জেলা পরিষদের ঘাট দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

কাজিরহাট থানা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সঞ্জয় চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চাই তার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করা হোক। দুদক অনুসন্ধানে নামলেই বেড়িয়ে আসবে এমপি পঙ্কজ দেবনাথের কালো টাকার সন্ধান। অমি যতদূর জানি তিনি ধানমন্ডিতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, উত্তরায় বিলাসবহুল ১০ তলা বাড়ি, মালিবাগে গার্মেন্টস, পরিবহন ব্যবসা, গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি, নিজের নামে লাল পাজেরো গাড়ি, একটি প্রাইভেট কার, চার কোটি টাকা মূল্যের নোভা মার্সিটিজ ব্যবহার করেন। দেশের অন্য কোনো এমপি এত দ্রুত এত টাকা আয় করতে পারেননি। দুর্নীতি না করে তিনি এসব করতে পারেননি। দুর্নীতির দায়ে পৃথক দুটি মামলায় তিনি ১৬ বছরের দণ্ডপ্রাপ্তও হয়েছেন।

দলের অভ্যন্তরে কোন্দল সৃষ্টি

পঙ্কজ দেবনাথ জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হলেও তিনি প্রকাশ্যেই জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধাচরণ করতেন। এমনকি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা প্রকাশ্যে করতেন। এ নিয়ে হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি এমপির অনুসারী অপরটি জেলা আওয়ামী লীগ অনুসারী। 

অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিতেন পঙ্কজ দেবনাথ। এই কোন্দলের সূত্র ধরে সহিংসতায় বেশ কয়েকটি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ ২৮ আগস্ট দুপুরে ছাত্রলীগ কর্মী রিমন ও তার চার বন্ধুকে হাসপাতালে ঢুকে কুপিয়ে জখম করেন পঙ্কজ দেবনাথের অনুসারী কাউন্সিলর সোহল মোল্লা ও তার সহযোগীরা। 

রিমন ঢাকা পোস্টকে জানান, সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের অনুসারী না হওয়ায় এই হামলা চালান তারা।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের সন্তোষ

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র কামাল খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথকে আওয়ামী লীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকেই খুশি হয়েছেন। আমরা নেত্রীর (দলের সভাপতি শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্তে বিশ্বাসী। উপজেলায় তিনি (সংসদ সদস্য) যা করেছেন তা আমরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের নেতৃবৃন্দকে জানিয়েছি। কেন্দ্র ও জেলা আওয়ামী লীগ তার কর্মকাণ্ড সর্ম্পকে অনেক আগে থেকেই জানে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশ চালায় আওয়ামী লীগ সরকার। সুতরাং কে কোথায় কী করেন সব কিছুই দল জানে। এমপি পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট করে বলার কিছুই নেই। তার কর্মকাণ্ডতো একটি আর দুটি না। সব কিছুই কেন্দ্র জানে এবং সেই অনুসারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

বিস্তারিত বলেননি পঙ্কজ নাথ

অব্যাহতি ও অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো বক্তব্য দেননি সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ। তিনি অব্যাহতিপত্র পেয়েছেন বলে ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন। এর বেশি কিছু বলতে চাননি। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর