মাত্র ১২ বছর বয়স সালমানের। বাবা-মা ও ৫ ভাই-বোনের সংসার। বাবা-মা অসুস্থ। আয়ের পথ বন্ধ। তাই বাধ্য হয়ে ভ্যান নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে সালমানকে। ভ্যান চালিয়ে যে আয় হতো মাস খানেক ভালোই চলছিল। কিন্তু গত ১০ সেপ্টেম্বর যাত্রী বেশে ভ্যানে ওঠে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের সামনে বিরিয়ানি আনতে পাঠিয়ে ভ্যান চুরি করে নিয়ে যায় সালমানের।

ফিরে এসে সালমান ভ্যানটি না পেয়ে সদর হাসপাতালের সামনে বুক ফাটা আহাজারি করতে থাকে। এ ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়ে সালমান। থামছিল না তার কান্না। তার আর্তনাদ শুনে মানুষ একত্রিত হয়। যায় সাংবাদিকরাও। ওই দিনই দেশের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‌ঢাকা পোস্টে ‌'বিরিয়ানি আনতে পাঠিয়ে ভ্যান নিয়ে যায় চোর, কান্না থামছে না সালমানের' শিরোনামে সংবাদ ও ভিডিও চিত্র প্রকাশিত হয়।

ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত নিউজ ও ভিডিও ফেসবুকের মাধ্যমে চোখে পড়ে খুলনায় কর্মরত মানবিক পুলিশ সদস্য এসএম আকবরের। এরপর তিনি যোগাযোগ করে সালমানকে ভ্যান দেওয়ার আশ্বাস দেন। 

বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টম্বর) বিকেলে উই আর বাংলাদেশ (ওয়াব) এর প্রতিষ্ঠাতা, মানবিক পুলিশ সদস্য এসএম আকবরের দেওয়া নতুন ভ্যান পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন সালমান ও তার মা।

ভ্যান পেয়ে শিশু সালমান ঢাকা পোস্টকে বলেছে, ভ্যান পেয়ে আমার খুব খুশি লাগছে। আমি এই ভ্যান চালিয়ে কিস্তি দিতে পারব। ভালো লাগছে যে আকবর ভাই ভ্যানটি আমাকে দিয়েছেন। একটা দাবি রেখে সালমান বলে, আমার একটি বোন আছে, তার বিয়ের ব্যবস্থা করা এবং ঘর-দরজা করার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।  

ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে সালমান বলে, শনিবার কয়েকজন যাত্রী গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের সামনে থেকে গ্যাস সিলিন্ডার আনার কথা বলে তিনজন ভ্যানে ওঠে। তাদের একজন গ্যাস সিলিন্ডার আনতে দেরি হবে এই বললে পাশে ভ্যান তালাবদ্ধ করে রাখি। একজন স্পিড (পানীয়) কিনে খেতে বলে। আমি খাইনি। তারা খায়। এসময় একজন বলে মোবাইলের সিম খুলতে হবে তোর চাবিটা দে। আমি চাবি দিয়ে দেই। এরপর আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একজন বিরিয়ানি আনতে যায়। আমি রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসে দেখি আমার ভ্যান নেই। আমি কান্নাকাটি করলে লোকজন জড়ো হয়। তারপর সাংবাদিক ভাইয়েরা এসে সব শুনে নিউজ করে। আমাকে তারা বলে, চিন্তা করিস না তোর ভ্যানের ব্যবস্থা করে দিবানি। তাদের ভিডিও দেখে আকবর ভাই আমাকে ফোন দিয়ে ভ্যানের ব্যবস্থা করে দিবে বলেছিলেন। আজ সেই ভ্যান আমাদের তুলে দিয়েছে। এটা দিয়ে আমি ঋণ শোধসহ সংসার টুকিটাকি চালাতে পারব।

সালমানের মা কোহিনুর বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ৬ ছেলে-মেয়ে। এক ছেলে মারা গেছে। এখন ৫ ছেলে-মেয়ে রয়েছে। স্বামী অসুস্থ। গত শনিবার ছেলে জানায় ভ্যান চুরি হয়ে গেছে। ঋণ নিয়ে ভ্যান কিনেছি। এখন ভ্যান না থাকায় খুব কষ্টে চলছে। বোন বাড়ি থেকে কিছু চাল দিয়েছিল সেই দিয়ে চলছে। এখন কিস্তি দিতে হবে। কিভাবে চলবো সেই চিন্তাই রয়েছি। আমার পাশে যারা দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য দোয়া করি। ঠাকুরগাঁও থেকেও ভ্যান দেওয়ার জন্য বলেছে। এখন খুলনা থেকে আকবর স্যার ভ্যান দিলো। তিনি ছেলের মতো আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহায্য করছে। আমি এতে খুব খুশি। এখন ঋণ শোধ করতে পারবো। তার জন্য দোয়া করি।  

ওয়াব'র প্রতিষ্ঠাতা মানবিক পুলিশ সদস্য এসএম আকবর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেসবুকে হঠাৎ করে ঢাকা পোস্টের একটা নিউজ ও ভিডিও আমার চোখের সামনে আসে। ভ্যান চুরি হওয়ায় ওর (সালমান) যে কাঁন্না, সেই কাঁন্না দেখে আমি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। আর আমি যেহেতু বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজ করি ওয়াবের মাধ্যমে ভিডিও নিউজটা দেখে আমার কাছে আসলে খুবই খারাপ লেগেছে। আমি চিন্তা করলাম ওর জন্য আমি নিজে একটি ভ্যানের ব্যবস্থা করব। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা পোস্টের রিপোর্টারের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে কল দেই। কল দিয়ে সালমানের মোবাইল নম্বরটি সংগ্রহ করি। সালমানকে ফোন দিলে সে কাঁন্না-কাটি শুরু করে। আমি নিজেও কেঁদে ফেলি। সালমান প্রত্যেকটা মুহূর্তে কান্না করছে। আমি জানিয়েছি আমার সংগঠন ওয়াব'র পক্ষ থেকে সালমানকে একটি ভ্যান দেব। মানুষের দুর্ভোগে আমরা সবাই যদি এগিয়ে আসতাম তাহলে সমাজের চিত্রটা পাল্টে যেত।

তিনি বলেন, মানবিক সাংবাদিকতা খুবই দরকার। যদি আজকে এই নিউজটা আমার চোখে না পড়তো তাহলে এগিয়ে আসতে পারতাম না। একটা ভালো কাজ করার সুযোগ পেতাম না। মানবিক সাংবাদিকতা, মানবিক চিন্তাধারা, থাকলে আমাদের দেশ অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি সালমানরা ৪/৫ ভাই-বোন। ওদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। ওই সময় আমি শুধু তার ভ্যান হারানোর খবর জানতাম। এখন জানতে পারলাম ওদের পারিবারিক অবস্থা একেবারে ভঙ্গুর। তাদের ঘর নেই, সেখানে সাংবাদিকরা উদ্যোগ নিয়েছে ঘর করে দেওয়ার। আমি সেখানেও সহযোগিতা করবো। সালমানের বোনকে বিয়ে দেবে। বলেছি, যদি বেঁচে থাকি তাহলে তার বিয়েটাও আমি দিয়ে দেবো-ইনশাআল্লাহ।

এছাড়াও ঢাকা পোস্টে সালমানকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ পর তাকে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে আর্থিক সহায়তা করেছে মানবিক মানুষগুলো। সেই টাকা দিয়ে সালমানের ভাঙা ঘরটি সংস্কার করা হবে। সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছেন স্থানীয় সেচ্ছাসেবী এম আরমান খান জয়। 

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা পোস্টের নিউজ থেকে নম্বর সংগ্রহ করে অনেকে সালমানকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন। এছাড়াও আমরা প্রথম দিন থেকে স্থানীয়ভাবে কিছু টাকা সংগ্রহ করেছি। সেই টাকা দিয়ে সালমানের ভাঙা জরাজীর্ণ ঘরটি সংস্কার করা হবে। শুক্রবার আমরা ঘরের কাজটি শুরু করব। ঢাকা পোস্ট এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সংবাদটি প্রকাশ হওয়ার কারণে সালমান ভ্যানও পেল, ঘরও পেল।

 

মোহাম্মদ মিলন/এমএএস