পরীক্ষা শুরুর মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মাথায় বহিষ্কার হওয়া সেই ৯ এসএসসি পরীক্ষার্থী হতাশায় ভুগছে। লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে তারা ভুল পথ বেছে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা। এতে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।

এ ঘটনায় পরীক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী। নোটিশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইসমাইল রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়।

এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার খারিজ্জমা ইসহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শনে যান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইসমাইল রহমান। পরীক্ষা শুরু হলে তিনি কক্ষ পরিদর্শন শুরু করেন। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে তিনি ওই কেন্দ্রের ৯ পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেন। ওই ৯ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৭ জন তখন পর্যন্ত খাতায় রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া কিছুই লেখেননি। বাকি দুজনের একজন দুটি উত্তর এবং অপরজন তিনটি উত্তরের বৃত্ত ভরাট করেছিল কেবল।

এ ঘটনার পর থেকে এলাকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছেন। অনেক পরিবার তাদের সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। কয়েকজন পরীক্ষার্থী এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী সুমাইয়ার বাবা শাহাবুদ্দিন হাওলাদার বলেন, বহিষ্কারের পর থেকে আমার মেয়ের গায়ে জ্বর। ও কোনো কথা বলে না। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। 

আরেক শিক্ষার্থী ইমার বাবা চুন্নু হাওলাদার বলেন, আমার মেয়ে বহিষ্কার হওয়ার পর থেকে বারবার বলছে- ‘সুইসাইড করব’। সেদিনের পর থেকে তাকে পাহারা দিয়ে রাখতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন : কেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেট ঝড়, ৫ মিনিটেই বহিষ্কার ৯, তীব্র সমালোচনা

বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী লিয়া আক্তারের বাবা লতিফ মৃধা বলেন, আমার মেয়েকে এখন সঙ্গে সঙ্গে রাখি। ও বারবার বলে- ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে।’ আমি এই মেয়েকে রেখে কোথাও যেতে পারছি না। আমার এখন কী উপায় আছে?

পরীক্ষার্থী লিয়া আক্তার বলেন, পরীক্ষার খাতায় রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া কিছুই লিখতে পারিনি। ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের কথা তিনি শোনেননি। কত কষ্ট করে বাবা-মা পড়াশোনা করান। একটি বছর আমার জীবন থেকে শেষ হয়ে গেল।

পরীক্ষার্থী শোয়েব সরদার বলেন, কিছুদিন পর আমার বন্ধুরা সবাই কলেজে পড়াশোনা করবে। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। বাড়িতে মানুষজন আমাকে দেখতে আসে। আমি কী অপরাধ করেছি? আমার জীবন থেকে শুধু শুধুই একটা বছর নষ্ট করে দিল।

পরীক্ষার্থী ইমা আক্তার বলেন, পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর আমি বহুনির্বাচনীর উত্তর পূরণ করছিলাম। তখন আমার‌ কলম নিচে পড়ে যায়। আমি কলম তুলতে গেলেই ম্যাজিস্ট্রেট স্যার এসে আমাকে বলেন- ‘তোমার খাতা দিয়ে দাও, তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে না।’ অনেক অনুরোধ করার পরও স্যার আমাদের কথা শোনেননি।

আরও পড়ুন : ৯ পরীক্ষার্থীর বহিষ্কার : ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নোটিশ

এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে পটুয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. জাফর আহমেদ বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শিক্ষার্থীরা এমন কী ভুল করেছে যার জন্য তাদের এক বছর বহিষ্কার করতে হবে? শিক্ষার্থীরা সবসময় সুযোগ নিতে চাইবে। যদি শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন বদল করে থাকে, তাহলে তখন হল পরিদর্শক কী করেছে? পরীক্ষা কেন্দ্রের যে পরিদর্শক ছিলেন তাকেও তো তাহলে বহিষ্কার করা উচিত ছিল।

এ বিষয়ে পরীক্ষার হল সুপার ও খারিজ্জমা ইসহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান মনি বহিষ্কারের দিন ঢাকা পোস্টকে বক্তব্য দিলেও এখন তিনি ফোন রিসিভ করছেন না।

ঘটনার দিন নুসরাত জাহান মনি বলেছিলেন, আমাদের কেন্দ্রে পরীক্ষা শুরুর পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যেই ৯ জনকে বহিষ্কার করা হয়। তবে ৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র একজন এমসিকিউ উত্তরের দুটি ঘর পূরণ করেছে। অপরজন তিনটি উত্তর ভরাট করেছে। বাকি সাতজন শুধু রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বরের ঘর পূরণ করেছে। আমি স্যারকে (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু স্যার আমার কথা রাখেননি। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বহিষ্কারাদেশ লিখেছেন।

পরীক্ষার্থী ইমা আক্তার বলেন, পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর আমি বহুনির্বাচনীর উত্তর পূরণ করছিলাম। তখন আমার‌ কলম নিচে পড়ে যায়। আমি কলম তুলতে গেলেই ম্যাজিস্ট্রেট স্যার এসে আমাকে বলেন- ‘তোমার খাতা দিয়ে দাও, তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে না।’ অনেক অনুরোধ করার পরও স্যার আমার কথা শোনেননি।

সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইসমাইল রহমান বলেন, বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেরা দেখাদেখি ও প্রশ্ন এক্সচেঞ্জ করেছিল। এজন্য তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের পরীক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে, এ ঘটনায় পরীক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী। নোটিশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইসমাইল রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়।

আরএআর/জেএস