স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে দিন দিন রংপুর মহানগরীতে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তিনি বলেন, সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি জরিপে মহানগরীর ১১ হাজার ৭৮ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ৩৩ ভাগ মানুষের উচ্চ রক্তাচাপ শনাক্ত হয়েছে। পুরো নগরজুড়ে এমন জরিপ হলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি ও আক্রান্তের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসবে। এ জন্য নগরবাসীকে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিমিত খাবার গ্রহণ ও নিয়মিত শরীরচর্চার পরামর্শ দেন তিনি।

সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নগর ভবনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ‌‌‘স্থানীয় পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থুলতা স্ক্রিনিং বিষয়ক কার্যক্রমের ফলাফল আলোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ নগর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় সিডিসি ও সেভ দ্য চিলড্রন এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

আলোচনার শুরুতেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের ঝুঁকি তুলে ধরে সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কামরুজ্জামান ইবনে তাজ বলেন, ৪০-৬৫ ভাগ বয়স্ক মানুষ বিভিন্ন ধরনের উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এদের মধ্যে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান অর্থাৎ যারা মোটা, তাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি। বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন আসছে। এখন আমরা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ফাস্ট ফুড এবং জাঙ্ক ফুড বেশি খেয়ে থাকি। প্রতিনিয়ত জাঙ্ক ফুড গ্রহণে স্থূল মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত পরিমাণে জাঙ্ক ফুড গ্রহণের ফলে মানুষের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং স্থূল হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফাস্ট ফুড খাওয়ার জন্যই সারাবিশ্বে মোটা হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। এসব খেলে রক্তে চিনির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, ৬৫ ভাগ সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তাদের মধ্যে আবার ৭৫ ভাগ মানুষই হচ্ছে শহর এলাকার। গ্রাম এলাকার মানুষের চেয়ে শহরে থাকা মানুষ বেশি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছেন। রংপুর সিটি করপোরেশনে আগের চেয়ে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। ১১ হাজার ৭৮ জনের ওপর গবেষণা করে ৩৩ ভাগ মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ পাওয়া গেছে। ১৭ ভাগ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের ঝুঁকিতে আছেন। গবেষণায় উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি নেই এমন মানুষ মিলেছে ৫০ ভাগ। যাদের উচ্চ রক্তচাপের কোনো সমস্যা ছিল না।

ডা. কামরুজ্জামান বলেন, গবেষণায় বা জরিপে ১১ হাজার ৭৮ জনের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক ওজনের ৫৯ ভাগ মানুষ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে অপুষ্টিতে ভুগছেন এমন মানুষ পাওয়া গেছে ৯ ভাগ। ঝুঁকিপূর্ণ ওজনের মানুষ ২২ ভাগ এবং ৩২ ভাগ মানুষ আছে যারা বিভিন্ন কারণে উচ্চ রক্তচাপ ঝুঁকিতে ভুগছেন।

রংপুর সিটিতে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের রোগী পাওয়া গেছে ২৯ ভাগ। ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩৪ ভাগ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। ষাটের উর্ধ্বে আছে এমন মানুষের সংখ্যা ৩১ ভাগ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ এবং ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের জন্য সতর্কতা অবলম্বন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই জরুরি। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন বা অস্বাভাবিক মোটা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ ফাস্ট ফুড এবং জাঙ্ক ফুডসহ তেল জাতীয় মুখরোচক খাদ্যাভ্যাস।

এই গবেষণা থেকে সবাইকে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, আগের চেয়ে আমরা উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছি। দেশ উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় উন্নত দেশের খাবারসহ ফাস্ট ফুড ও জাঙ্ক ফুড যোগ হয়েছে। এসব খাবার আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ানোর সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমাদের অনেকে আছে যারা পরিমিত খাবার খাচ্ছে না, নিয়মিত ব্যায়াম করছে না, অলসতার মধ্যে থাকছে, তাদের জন্য উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অনেক বেশি। আগের মানুষ খুব পরিশ্রম করতেন, এখন সেই তুলনায় পরিশ্রম করতে হয় না। এটাও আমাদেরকে রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সচেতনতার বিকল্প নেই।

মেয়র বলেন, অধিক ওজন, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম/কায়িক শ্রম না করা, তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবন, লবণ খাওয়া, ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপের প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, এটা উদ্বেগের। আমরা সিটি করপোরেশন থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি। নগরবাসী যত বেশি সচেতন হবে, তত বেশি উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ থেকে ঝুঁকিমুক্ত হওয়া যাবে।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সেভ দ্য চিলড্রেনের জনস্বাস্থ্য রোগতত্ববিদ ডা. পলাশ কুমার রায়, রংপুর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ও স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মো. আব্দুল কাইয়ুম, কাউন্সিলর হারাধন রায় প্রমুখ।
 
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ইউএস সিডিসির অর্থায়নে ও সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় নগর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্পটি রংপুর সিটি করপোরেশনসহ দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনে বাস্তবায়িত হচ্ছে। যা সকল সিটি করপোরেশনের জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ওই প্রকল্পের আওতায় রংপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ‘উচ্চ রক্তচাপ ও স্থূলতা স্ক্রিনিং’ বিষয়ক দুই মাসব্যাপী স্ক্রিনিং এবং সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালিত হয়। ক্যাম্পেইনের আওতায় এ বছরের ৩১ মে থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত রংপুর সিটি করপোরেশনের ১০টি ওয়ার্ডে উচ্চ রক্তচাপ ও স্থূলতা পরিমাপ করা হয় এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পোস্টার ও লিফলেট বিলি করা হয়।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর