১৯৮৮ সালের দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও সদর উপজেলায় পদ্মা নদীর মাঝে জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ চর। এরপর সেখানে শুরু হয় বসতি স্থাপন। শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দশ রশিয়া থেকে সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের বত্রিশ রশিয়া পর্যন্ত এই চরে গড়ে ওঠে নতুন জনপদ। এরপর প্রায় ৩০ বছরে এই জনপদের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০-৬০ হাজারে।

মূল ভূখণ্ড থেকে দূরত্ব থাকলেও ভারত সীমান্তের কাছের এই জনপদের মানুষ পায় সরকারি সকল সহায়তা। চরের ফসলি জমির উর্বরতাকে কাজে লাগিয়ে তারা উৎপাদন করে মাসকলাই, ধান, কলা, পাট, ভুট্টাসহ নানা ফসল। অন্যান্য জমির তুলনায় ফলনও হয় ভালো। সব মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে পদ্মার ভাঙন চলে আসে এই চরে। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দেয়। গত ৪ বছরের তুলনায় এবার তীব্র আকার ধারণ করেছে নদী ভাঙন। 

ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি হারিয়েছে প্রায় হাজার তিনেক পরিবার। তাদের অধিকাংশ নদীর ওপারের নিশিপাড়া চরে নতুন করে আবাসন গড়েছেন। হুমকিতে পড়েছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সংযোজন করা চরের বিদ্যুৎ সংযোগ। ভারত থেকে বয়ে আসা পদ্মা নদীর তীব্র স্রোতে ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি ও বসতবাড়ি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসাও যাচ্ছে নদীর পেটে। এখন হুমকিতে রয়েছে অন্তত ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বহু ফসলি জমি ও বসতবাড়ি। 

স্থানীয়রা বলছেন, ২০১৮ সাল থেকে ভাঙন শুরু হওয়ার পরপর ব্যবস্থা নিলে ভাঙনের তীব্রতা এত বেশি হতো না।

ভাঙন আগ্রাসী রূপ নেয়ায় চরের শিবগঞ্জের পাঁকা ইউনিয়নের দশরশিয়া বাজারে দোকানপাট ভেঙে নিতে দেখো গেছে স্থানীয়দের। এছাড়া নদীর কাছাকাছি যাদের বসতবাড়ি, তারাও বাড়ির আশপাশে থাকা গাছপালা কেটে বাড়ি ভেঙে নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এই চরে থাকা বাসিন্দারা নদী ভাঙনের কবলে পড়েই এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। আবার নদী ভাঙনের কারণেই এখন এই চর ছেড়ে আরেক চরে আশ্রয় নিচ্ছেন তারা। 
 
দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের মো. আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত চার বছর ধরে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে এখানকার মানুষ সব হারালেও তা রোধে কোনো ভূমিকা নেওয়া হয়নি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে নদী ভাঙন রোধে কাজ শুরুর কথা বারবার আসলেও তার বাস্তবায়ন দেখতে পাইনি। ইতোমধ্যে এই এলাকায় আমরা অনেকগুলো মসজিদ মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হারিয়েছি। নদী ভাঙন ঠেকাতে উদ্যোগ নিলে এসব রক্ষা করা সম্ভব হতো। সরকারের নিকট আকুল আবেদন, এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে আমাদের রক্ষা করুন। 

কলেজছাত্র শামীম রেজা জানান, ভাঙনের কবলে পড়ে দক্ষিণ পাঁকা চরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। যেখানে বাড়ি করেছিলাম সেটি নদী থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ছিল। কিন্তু ভাঙতে ভাঙতে এখন নদী খুব কাছে চলে এসেছে। বাধ্য হয়ে আবার বাড়ি ভাঙতে হবে। আরেক জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এক ইঞ্চি জমিও যাতে ফাঁকা না থাকে। তাহলে আমরা কেন নিজেদের এক ইঞ্চি জায়গাও নদীতে ভাঙতে দিব? তাই সরকারের নিকট আকুল আবেদন, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। 

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সুমন আলী বলে, এবার ভাঙন বেড়েছে। যে কারণে দ্রুত ঘরবাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে। এখানে বড় একটা হাট ছিল। অনেক দোকানপাট ছিল। সেই হাটের কিছু অংশ নদীতে নেমে গেছে। তাই আশপাশের দোকানগুলো এখন ভেঙে নেওয়ার কাজ চলছে।

গৃহবধূ মনিরা বেগম বলেন, আমাদের বাড়িও নদীর খুব কাছে চলে এসেছে। তাই বাড়ির আশপাশে থাকা সব গাছ কেটে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে যাব। একটি গাছ মানুষ করা, আর একটি ছেলে মানুষ করা প্রায় সমান। যে গাছ এত যত্ন করে বড় করেছি, তা কেটে ফেলতে হচ্ছে। মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আকুল আবেদন, দ্রুত এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে এই জনপদকে রক্ষা করুন। 

ষাটোর্ধ্ব মকবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা নদীর ভাঙনই এমন। গত কয়েক দশক ধরে আমরা যখন দক্ষিণ দিক ভেঙে যায়, তখন উত্তর দিকে এসে আশ্রয় নিই। আবার উত্তর দিক ভেঙে গেলে দক্ষিণে আশ্রয় নিই। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন। একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করলে ভাঙন রোধ করা যেত। 

নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নাজির হোসেন জানান, ২০১৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁকা ও নারায়ণপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভাঙন শুরু হয়েছে। নারায়ণপুরের তুলনায় পাঁকা ইউনিয়নে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে চলতি বছরে। ২০১৮ সালে ভাঙনের শুরুর সময় যদি কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হত, তাহলে ভাঙনের তীব্রতা এ বছর এত বেশি দেখা যেত না। ভাঙনের তীব্রতা এমন যে, পাঁকা ইউনিয়নের দুইটি ওয়ার্ড নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি বিজিবি ক্যাম্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি হুমকিতে রয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, দশরশিয়া থেকে বত্রিশ রশিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের ভাঙনটা খুব তীব্র। পানি উন্নয়ন বোর্ড সাধারণত চর এলাকায় কাজ করে না। কিন্তু এই চরের বাসিন্দারা সরকারের সকল সুবিধা পেয়ে থাকেন এবং জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় এমপির যোগাযোগের ফলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ভাঙনরোধে ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। 

তিনি বলেন, এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে গেলে পাঁচ কিলোমিটারের জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন। এছাড়া এখানে পাথর ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে আসা অনেক কষ্টসাধ্য। একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কম খরচে কীভাবে স্থায়ী সমাধান সম্ভব তার প্রতিবেদন দেবেন। গত শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) থেকে ইতোমধ্যে চর পাঁকার পয়েন্ট থেকে ৩৩০টি জিও টিউব ও ১ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন বলেন, জিও টিউব ও জিও ব্যাগ দিয়ে স্রোতের বাধা সৃষ্টি করে ১০টি জায়গায় বালু ফেলা হচ্ছে। এতে নদী ভাঙন থেকে এই এলাকা রক্ষা পাবে বলে আশা করছি। এছাড়া ভাঙন রোধে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের আশ্বস্ত করেছি, সরকার তাদের পাশে রয়েছে। 

জাহাঙ্গীর আলম/আরএআর