সমাজের কুসংস্কার ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে কৃষ্ণা রাণী সরকারকে। শুনতে হয়েছে মানুষের কটূ কথা। সমাজের কটাক্ষ সইতে না পেরে কৃষ্ণার খেলা বন্ধ করতে তার প্রিয় বলটি বটি দিয়ে কেটে আগুনে দিয়েছিল পরিবার। তবুও থামেনি অদম্য কৃষ্ণার ফুটবল খেলা। টাঙ্গাইলের গোপালপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল উত্তর পাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে শুরু হয় তার জয়রথ। তবে ফুটবল খেলে পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি কৃষ্ণা। ফলে ফুটবলের উন্নতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি দাবি তার পরিবারের। 

দুর্গোৎসবের এখনো বেশ কয়েক দিন বাকি। তবে অদম্য কৃষ্ণার বাড়িতে এখন সেই উৎসবের থেকেও বড় উৎসবে চলছে। নিজ পরিবার তো বটেই এখন সর্বত্রই চলছে কৃষ্ণার বন্দনা। কারণ কৃষ্ণার জোড়া গোলে এশিয়ায় নারী ফুটবলে সেরা হয়েছে বাংলাদেশ। সেরা খেলোয়ারও হয়েছেন কৃষ্ণা। 

গত সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) নেপালে অনুষ্ঠিত নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলার অদম্য মেয়েরা। যেখানে জোড়া গোল করেছেন সাবেক অধিনায়ক টাঙ্গাইলের গোপালপুরের মেয়ে কৃষ্ণা রাণী সরকার।

মঙ্গলবার সরেজমিনে কৃষ্ণা রাণী সরকারের গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নারী খেলোয়াড়দের জয়ে উল্লাস চলছে পুরো গ্রামে। ভোর থেকে কৃষ্ণার বাড়িতে অসংখ্য মানুষ ভিড় করেছে। চাচার ঘরের ঘরের বারান্দায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে কৃষ্ণার অর্জিত সব ট্রপি, খেলার ছবি ও সার্টিফিকেট। মেয়ের সফলতায় আনন্দে আত্মহারা কৃষ্ণার বাবা-মা।

জানা গেছে, উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে পাথালিয়া গ্রাম। আর এই গ্রামে প্রবেশ করার আগে পশ্চিমে ঝিনাই নদী আর পূর্বে বিস্তীর্ণ ডগাবিল। এই গ্রাম ভেদ করে মুশুদ্দী হয়ে ধনবাড়ি-ঝাওয়াইল সড়ক চলে গেছে। ওই সড়কের পাশের ১০০ গজ ভেতরে কাঁচা রাস্তা দিয়ে গেলেই ফুটবলকন্যা কৃষ্ণাদের বাড়ি। তার বাবা বসুদেব সরকার একজন কৃষক। মা নমিতা সরকার গৃহিণী। তার ভাই পলাশ ঢাকার গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে কৃষ্ণার চাচা ও ফুফুদের সাংসারিক অবস্থাও নাজুক। বাড়িঘরগুলোও ভাঙাচোরা। সবাই কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

কৃষ্ণা খেলাধুলা করে যে টাকা উপার্জন করেন তা দিয়ে সংসার ও ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হয়। কৃষ্ণার আয়ের ওপর নির্ভর করে তাদের সংসার। তবে বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সহায়তা করলেও তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি মেলেনি। থাকার জন্য একটি পাকা ঘর করলেও টাকার অভাবে সেটির কাজ শেষ করতে পারেনি। তবে এবার খেলায় জয়ী হওয়ায় যে টাকা পাবেন সেই টাকায় বাড়ির কাজ শেষ করার আশা করছেন কৃষ্ণার বাবা বসুদেব সরকার। 

এদিকে কৃষ্ণাদের বাড়ি যাওয়ার পথটিও কাঁচা। বৃষ্টি হলেই রাস্তাটি দিয়ে চলাচল করা দুষ্কর। ফলে পাকা সড়কে নেমে কাদাযুক্ত রাস্তায় হেঁটে বাড়ি যেতে হয়।

কৃষ্ণার মা নমিতা রাণী সরকার বলেন, আমরা খুবই গরিব মানুষ। এক সময় টাকার অভাব ও গ্রামের মানুষের কটূ কথার কারণে মেয়েকে ফুটবল খেলতে বারণ করেছিলাম। তারপরও কৃষ্ণার ইচ্ছা শক্তির কাছে কটূক্তি করা মানুষজন হেরে গেছে। সে এখন দেশের গৌরব। সবাই তার প্রশংসা করছে। তবে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি হচ্ছে না আমাদের। এক মেয়ের ওপর নির্ভর করে সংসার খরচ ও ছেলের পড়াশোনা। কৃষি কাজ করে তেমন আয় হয় না। সরকার বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পূর্বের ন্যায় আমার মেয়ে এবং আমাদের দিকে সুনজর দিলে হয়তো অর্থনৈতিকভাবে আমাদের মুক্তি মিলবে। এছাড়া মেয়েটি যেন গাড়ি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে সেজন্য বাড়ির রাস্তাটি পাকা করার দাবি জানাই। 

কৃষ্ণার বাবা বসুদেব সরকার বলেন, ছেলে খেলোয়াড়রা অনেক টাকা বেতন পায়। অথচ মেয়েরা সামান্য সম্মানি পায়। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও দেশসেরা হয়েছে। সুতরাং তাদের কেন ন্যায্য বেতনভাতা দেওয়া হবে না। বাফুফের সভাপতি আমাকে বলেছিলেন, ‘মেয়েরা যেভাবে পরিশ্রম করে সেই অনুযায়ী কোনো কিছু দেওয়া হয় না। আমরা বেতন দিতে পারছি না। হাত খরচার জন্য দেওয়া হয়। কোনো একদিন হয়ত মেয়েরাও ছেলেদের মতো বেতন, গাড়ি-বাড়ি পাবে।’ এর আগে খেলাধুলার জন্য প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে কিছু জমি কেনা হয়েছে। এছাড়া থাকার মতো একটা বাড়ি করছি। সেটা টাকার অভাবে শেষ করতে পারছি না। এই খেলায় যে টাকা আসবে, সেই টাকা দিয়ে বাড়ির কাজ শেষ করার ইচ্ছা রয়েছে। 

উল্লেখ্য, নেপালের কাঠমুন্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় অনুষ্ঠিত নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারে মতো শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। দেশের পক্ষে তিন গোলের দুটোই করেছেন কৃষ্ণা রাণী সরকার। খেলার ১৩ মিনিটে একটি ও ৪১ মিনিটে আরেকটি গোল করে বাংলাদেশের জয়কে নিশ্চিত করেন কৃষ্ণা রাণী সরকার।

আরএআর