প্রতিষ্ঠার দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরী উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। বিভিন্ন সংকট আর সমস্যায় জর্জরিত বিসিকে নেই কর্মচঞ্চলতা। এক দিকে পানির সংকট, অপর দিকে নেই ভালো রাস্তা, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে সম্ভাবনাময় বিসিকের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ। এই অবস্থায় শিল্প কারখানা টিকিয়ে রাখতে দ্রুত পানি সংকট নিরসন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা ও উদ্যোক্তারা।

তবে বিসিক র্কতৃপক্ষ জানিয়েছে, বিসিকে সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সাবমারসিবল পাম্প বসানোর জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, ইতোমধ্যে বিসিকের গেট ও একটি রাস্তার নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব অন্যান্য সমস্যা সমাধান করে বিসিক শিল্প নগরীকে ব্যবসায়ী বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

জানা গেছে, শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) ১৯৯৬ সালে বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদের পাশে প্রায় ২১ একর জমির ওপর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নগরী গড়ে তোলে। এই শিল্প নগরীতে ১২৩টি প্লটের সবকটিই বরাদ্দ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য রয়েছে পল্লী বিদ্যুতের উপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নারকেল তেল, অটো রাইস, সরিষা, ডাল মিল, ইজিবাইক সেটিংস, পুরাতন প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাতকরণ, কোকোনাট ফাইবার মিলস অন্যতম।

বিসিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জমির লিজ বাবদ বিসিক ২ কোটি ৪৩ লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করেছে। এই সময়ে সার্ভিস চার্জ, পানির বিল ও ভূমি কর বাবদ আয় হয়েছে ১ কোটি ৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২০১৭ সালে শিল্প নগরীতে থাকা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ, ভূমি উন্নয়ন কর ও পানির বিল বাবদ আয় ২০ লাখ ৫ হাজার টাকা, একই খাত থেকে ২০১৮ সালে ৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ১০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা, ২০২০ সালে ১০ লাখ ৪ হাজার টাকা, ২০২১ সালে ১৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা। কোনো বছর বেশি আয়, আবার কোনো বছর কমের কারণ হিসেবে বকেয়া বিলের কথা উল্লেখ করেন বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বিসিকের অবকাঠামো খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ সালের বরাদ্দ করা প্রায় এক কোটি টাকার মধ্যে ৩৫ লাখ টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয় পানি সমস্যা নিরসনের জন্য। তবে এখন পর্যন্ত তিনবার মাটি পরীক্ষা করলেও জায়গা নির্বাচন বা কাজ শুরু করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জামান এন্টারপ্রাইজ।

বিসিক শিল্প নগরীতে কাজ করা আয়েশা বেগম নামে এক নারী শ্রমিক বলেন, এক দিকে রাস্তা খারাপ, হেঁটে আসা যায় না আবার বৃষ্টির সময় পানিতে পথ নিমজ্জিত থাকে। রাস্তা খারাপের কারণে ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা দিলেও রিকশা বা ভ্যান আসতে চায় না।

বিসিকের একাধিক শ্রমিক জানান, সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই বিসিকে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি খেলেও গরমের সময় পানি কিনে খেতে হয়। রান্না ও গোসলের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে হয় বাইরে থেকে। আগের চেয়ে বেতন কম পান এখন। সেই বেতনে সংসার চালানো দায় তাদের।

বিসিকে অবস্থিত একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিক মো. আজমীর বলেন, বিস্কুট তৈরির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সুপেয় পানি। অথচ এখানে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ প্রতি মাসে ঠিকই ২০০ টাকা করে পানির বিল দিতে হয়। আবার পানি কিনতে হয় বাইরে দিয়ে। ফ্যাক্টরিতে ৮-১০ জন শ্রমিক কাজ করার সক্ষমতা থাকলেও পানির অভাবে মাত্র তিনজন দিয়ে কোনোরকম ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি।

শিল্প নগরীতে অবস্থিত কোকোনাট ওয়েল মিল সাহা এন্টারপ্রাইজের মালিক জীবন কৃষ্ণ সাহা বলেন, সরকারকে ঠিকমতো ভ্যাট-ট্যাক্স দিলেও শিল্পবান্ধব কোনো পরিবেশ নেই বাগেরহাট বিসিকে। একটু বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে যায়। ড্রেন থেকে পানি নিষ্কাশন হয় না।

সমস্যা সমাধানে রাস্তা-ঘাট সংস্কার ও পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি মালিক ও শ্রমিকদের।
পেশা বদলে ফেলা বিসিকের অন্তত ৬ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঁচ বছর আগে যে মজুরি পাওয়া যেত, এখনও তাই আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমেছেও। ফলে বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়েই পেশা বদল করছেন তারা।

বাগেহাট বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সভাপতি শিব প্রসাদ ঘোষ বলেন, এক সময় বিসিকে ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে চলত বেশির ভাগ মিল। দম ফেলার ফুসরত ছিল না শ্রমিকদের। অনেক দূর থেকে শোনা যেত মেশিন চলার শব্দ। সেই দিন এখন অতীত। দেড় যুগের ব্যবধানে শিল্প নগরীর প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ৫৭ থেকে ৩৭টিতে নেমে এসেছে। শ্রমিক সংখ্যা নেমে এসেছে ১৫০০ থেকে ৭০০তে।

তিনি আরও বলেন, দুই বছর আগে পানির পাম্প বসানোর জন্য ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। কিন্তু এত দিনেও সে কাজ শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। অথচ প্রতি মাসে আমাদের পানির বিল দিতে হয়। বিসিককে নতুন উদ্যমে সচল করতে বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকার ও উন্নয়ন নিশ্চিতের দাবি এই ব্যবসায়ী নেতার।

বিসিক বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) শরীফ সরদার বলেন, বিসিকের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বেশ বরাদ্দ রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা বিসিকের গেট ও একটি রাস্তার নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছি। অন্যান্য যেসব  ভাঙাচোরা সড়ক রয়েছে, সেগুলোও পর্যায়ক্রমে নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বিসিকে সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সাবমারসিবল পাম্প বসানোর জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু মাটির নিচে পাথর থাকায় এবং ডিজাইনে কিছু সমস্যা থাকায় কাজটি ব্যাহত হচ্ছে। ঠিকাদার নকশা সংশোধনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে সাবমারসিবল পাম্পের কাজ শুরু হবে।

বিসিক শিল্প নগরীর বিষয়ে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, বিসিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যদি আন্তরিক হন, তাহলে এই সংকট নিরসন করে শিল্প নগরীতে আগের জৌলুস ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

তানজীম আহমেদ/এসপি