নওশের আলী শেখের বয়স ৭০ পেরিয়েছে। ১৯৬৯ সালে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন রাজবাড়ী সরকারি কলেজে। সেসময় কলেজে যাতায়াতের সুবিধাজনক মাধ্যম ছিল ট্রেন। তাই নিজ বাড়ি থেকে ট্রেনে করে প্রতিদিন আসা যাওয়া করতেন তিনি। পড়ালেখার সুবাদে দীর্ঘ চার বছর তিনি এভাবে ট্রেনে যাতায়াত করেছেন। সে সময় তিনি কখনো টিকিট কেটেছেন আবার কখনো ছাত্র পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ করেছেন।

তবে জীবনের শেষ সময়ে এসে হঠাৎ বোধোদয় হয়েছে নওশের আলী শেখের। বিবেকের তাড়না ও অনুশোচনা থেকে তিনি নিজেই রাজবাড়ী রেলস্টেশনে আসেন। হিসাব করে ছাত্রাবস্থায় বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের জন্য বকেয়া ৫ হাজার টাকা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের হাতে বুঝিয়ে দেন।

শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকালের দিকে রাজবাড়ী রেলওয়ে রেলস্টেশনে এ ঘটনা ঘটে। বিনা টিকিটে ভ্রমণ করে বিবেকের তাড়না থেকে ভাড়া পরিশোধের বিষয়টিকে বিরল ও ব্যতিক্রম বলে মন্তব্য করেছেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিষয়টি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রাজবাড়ী সার্কেল নামে একটি ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হলে সেখানেও নওশের আলী শেখকে সাধুবাদ জানান অনেকেই।

জানা গেছে, নওশের আলীর বাড়ী রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের চর বেতেঙ্গা গ্রামে। তিনি ১৯৬৯ সালে গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর এইচএসসিতে ভর্তি হন রাজবাড়ী সরকারি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৭১ সালে এইচএসসি পাস করে একই কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৭৩ সালে রাজবাড়ী কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। 

নওশের আলী ছাত্র জীবনের চার বছর বাড়ি থেকে ট্রেনে করে রাজবাড়ী কলেজে ক্লাস করতেন। তখন বিনা টিকিটে ট্রেনে যাতায়াত করতেন। এরপর ১৯৭৫ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদ থেকে ২০১০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনের সমাপ্তির পর বর্তমানে তিনি অবসর জীবন অতিবাহিত করছেন।

নওশের আলী শেখ বলেন, মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হই রাজবাড়ী সরকারি কলেজে। তাই প্রতিদিন আড়কান্দি স্টেশন থেকে ট্রেনে রাজবাড়ী আসতাম। এ সময় কখনো টিকিট কাটতাম, আবার কখনো বিনা টিকিটে ছাত্র পরিচয় দিয়ে ট্রেনে আসতাম। বিষয়টি তখন খুব সহজ মনে হলেও শেষ বয়সে এসে এটি আমার বিবেককে নাড়া দেয়।

আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি তখন বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ করে অন্যায় করেছিলাম। জীবনের শেষ বয়সে এসে আগের ট্রেনের ভাড়া না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনুশোচনায় ভুগছিলাম। সেই অনুশোচনা থেকেই আনুমানিক একটি হিসাব করে ৫ হাজার টাকা রেল কর্তৃপক্ষের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে আমি দেনামুক্ত হলাম।

ট্রেনের টিকেট কালেক্টর মোকলেছুর রহমান সাগর বলেন, বিষয়টা ব্যতিক্রম। ইতোপূর্বে টিকিট না কাটা অনেকেই তাদের কাছে স্বল্প পরিমাণ অর্থ ফেরত দিয়েছেন। তবে নওশের আলী শেখের মতো এত টাকা ভাড়া কেউ পরিশোধ করেননি।

নওশের আলীর সহকর্মী সহকারী কৃষি অফিসার অরুন কুমার সরকার বলেন, নিঃসন্দেহে এটা একটি মহৎ কাজ। প্রতিটি মানুষ তার আত্মউপলব্ধির জায়গা থেকে নিয়মিত ট্রেনের ভাড়া এবং বকেয়া ভাড়ার টাকা সরকারি কোষাগারে প্রদান করাটা জরুরি।

রাজবাড়ী রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার তন্ময় দত্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, টিকিট ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণের দায় থেকে মুক্ত হতে আনুমানিক একটি হিসাব করে ৫ হাজার টাকা রেল কর্তৃপক্ষের হাতে বুঝিয়ে দেন নওশের আলী শেখ। আমরা তাকে ৫ হাজার টাকার একটি টিকিট কেটে দিয়েছি। এই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে।

মীর সামসুজ্জামান/এসপি