অবহেলিত কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি পাঠাগার, ঝুলছে তালা
‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।’ বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় এই কবিতার রচয়িতা কবি শেখ ফজলল করিমের ৮৬তম মৃত্যুবার্ষিকী (২৮ সেপ্টেম্বর) আজ। লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের পাশেই স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছিল কবি শেখ ফজলল করিমের পাঠাগার। তবে সেটিতে ঝুলছে তালা। মূল ফটকের সামনে আবর্জনা, জায়গা দখল করে বসেছে দোকানপাট। সামনে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই নতুন প্রজন্মের জ্ঞান ভান্ডার এটি।
পরিবার ও সরকারের সদিচ্ছায় জরাজীর্ণ বাড়িটি এখন পাকা হয়েছে। সেই পাকা ঘরের পাশেই রাখা হয়েছে কবির ব্যবহৃত স্মৃতিচিহ্ন। বর্তমানে স্মৃতিচিহ্নের রুমটিও এখন থাকে তালা দেওয়া। ফলে কবির ব্যবহৃত স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে কবির নামে একটি জাদুঘর নির্মাণ করে উন্মুক্ত করার দাবি জানান দর্শনার্থী ও কবিপ্রেমীরা।
বিজ্ঞাপন
প্রতি বছর কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এলেই তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় দর্শনার্থী ও কবিপ্রেমীদের ভিড় জমে। কিন্তু দর্শনার্থী ও কবিপ্রেমীদের দেখলেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক সময় ডাক দিলেও সাড়া দেন না কবির বাড়ির লোকজন। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে কবির স্মৃতিচিহ্ন না দেখে ফিরে যান। তাই দ্রুত কবির পাঠাগার ও জাদুঘর উন্মুক্ত করার দাবি কবিপ্রেমীদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতি বছরের এই দিনে কবি শেখ ফজলল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার বাড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। তবে এ উপলক্ষে কবির স্মৃতিচিহ্ন দেখতে কবির কক্ষটির তালা খোলা থাকলেও পুরো বছর বন্ধ রাখেন কবির পরিবারের লোকজন। যদিও সেখানে বলা আছে যে, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে কবির স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সেখানে গেলে ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দও মেলে না।
বিজ্ঞাপন
প্রায় দুই ঘণ্টা পর কবির নাতবউ এসে দরজা খোলেন। তখন তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, কত আর কবিকে দেখেন? এত দেখে লাভ কী? এখন এসব দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতি বছর অনেক মানুষ আসে আর দেখে চলে যায়। এখন রুমটি খোলা যাবে না। আমরা বিরক্ত- এই বলে তিনি দরজা বন্ধ করে চলে যান।
কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা না থাকলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ পালন করে। সেটিও কবির মৃত্যুবার্ষিকীর পরদিন। সেই অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজামান আহমেদ উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এছাড়াও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমানসহ পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সেখানে থাকবেন বলেও জানা গেছে।
জানা গেছে, কবির কক্ষের ভেতরে আছে অযত্ন-অবহেলার ছাপ রয়েছে। সৌখিন কারুকাজ করা কাঠগুলো উইপোকা খেয়ে ফেলেছে। কাঠের দেয়ালজুড়ে কবির বড় দুটো ছবি আছে। কবির ব্যবহৃত জীর্ণ চেয়ার, খাট ও একটি গ্রামোফোন রাখা আছে তার পাশে। এক কোণে কাচের একটি শোকেস। কাচগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আছে কবির ব্যবহৃত টুপি, দোয়াত-কলম, ছোট্ট কোরআন শরিফ, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ও কিছু বোতাম।
২০০৫ সালে কবির স্মৃতিরক্ষার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত হয় ‘শেখ ফজলল করিম গণপাঠাগার’। তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু এটি উদ্বোধন করেন। তখন এটি রক্ষার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা থাকলেও এখন আর তা নেই। পাঠাগারে নেই নিরাপত্তা প্রহরী ও পাঠক মহলের পদচারণা। কিছু দিন আগে রাসেল নামে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও বেতন পান না বলে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। বইপুস্তকগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে বইপ্রেমীরা এখন সেখানে যান না। পাঠাগারের পাশের দোকানপাট এটির সৌন্দর্য নষ্ট করেছে।
কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি গণপাঠাগারের সভাপতি ও চেয়ারম্যান তাহির তাহু এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে পাঠাগার নিয়ে কবির পরিবারসহ তার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। তাই তিনি পাঠাগারের কোনো খোঁজ রাখেন না।
কবিভক্ত এসকে রাসেল বলেন, জন্ম ও মৃত্যুর দিন আসলে আমরা জেগে উঠি। কিন্তু এরপর আর কারো কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায় না। গ্রামের কবি বলে তার মূল্যায়ন নেই। কবি শেখ ফজলল করিমের কবিতা, কাব্য আমাদের পাঁচটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার লেখা পাঠ্যবই থেকে বিলুপ্তপ্রায়। এসব নতুন করে জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। এ ছাড়া কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো দর্শনার্থীদের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে। তাহলে নতুন প্রজন্ম কবিকে জানতে পারবে।
কবির এক প্রতিবেশী বলেন, দর্শনার্থীরা সব সময় আসেন বলে তারা বিরক্ত হন। দর্শনার্থীরা এসে ডাকাডাকি করলেও তারা ভেতর থেকে আওয়াজ দেন না। এক রকম তারা বিরক্ত হয়ে গেছেন। আমরা চাই দ্রুত কবির ব্যবহৃত স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে একটি জাদুঘর নির্মাণ করে সব সময় খোলা রাখা হোক। তাহলে হয়তো শিশুরা কবির বিষয় জানতে পারবে। না হলে ধীরে ধীরে সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে।
সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভারতে আমাদের কবি শেখ ফজলল করিমকে মূল্যায়ন করে তাদের বইয়ে লেখা দিচ্ছে অথচ আমার দেশের বইয়ে তার লেখা নেই। বিষয়টি আমাদের ব্যথিত করে তুলেছে। তার কর্মগুলো আমরা আবার নতুন করে জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই। কবি শেখ ফজলল করিমের কবিতা ও কাব্য আমাদের পাঁচটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার লেখা পাঠ্যবই থেকে বিলুপ্তপ্রায়। এসব নতুন করে জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। এ ছাড়া কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো দর্শনার্থীদের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে। তাহলে নতুন প্রজন্ম কবিকে জানতে পারবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, পাঠাগারের সামনে থেকে দোকানপাট এর আগেও উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু আবারও তারা বসে দোকানপাট করছেন। আমরা দ্রুত এটির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এছাড়াও কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন যৌথ আয়োজন করবে।
কবি পরিচিতি
শেখ ফজলল করিম ১৮৮২ সালের ৯ এপ্রিল লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা বাজার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আমিরউল্লাহ সরদার এবং মায়ের নাম কোকিলা বিবি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
সাহিত্যকর্ম
শেখ ফজলল করিমর প্রথম বই ‘সরল পদ্য বিকাশ’ তার ১২ বছর বয়সেই হাতে লিখে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতা ও কাব্য ছাড়াও বহু প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, জীবনীগ্রন্থ, ইতিহাস, গবেষণামূলক নিবন্ধ, সমাজ গঠনমূলক ও তত্ত্বকথা গল্প, শিশুতোষ সাহিত্য, নীতিকথা চরিত গ্রন্থ এবং অন্যান্য সমালোচনামূলক রচনা লিখেছেন। পুঁথি সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তার পরিচিত পাওয়া যায়। তার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রায় ৫৫টি গ্রন্থ রয়েছে।
তার রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে তৃষ্ণা (১৯০০), পরিত্রাণ কাব্য (১৯০৪), ভগ্নবীণা বা ইসলাম চিত্র (১৯০৪), ভুক্তি পুষ্পাঞ্জলি (১৯১১) অন্যতম। উপন্যাস : লাইলী-মজনু, শিশুতোষ সাহিত্য হারুন-আর-রশিদের গল্প, নীতিকথা চিন্তার চাষ, ধর্মবিষয়ক পথ ও পাথেয়। তবে উল্লেখযোগ্য রচনাবলী ‘পথ ও পাথেয়’।
নিয়াজ আহমেদ সিপন/আরএআর