বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার কাপাসডাঙ্গা গ্রাম। বাড়ির আঙিনায় হেসে খেলে দিন কাটতো দুই বছর বয়সী শিশু সাকিবার। দিনমজুর বাবা শরিফুজ্জামানের আয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন চলে পরিবারটির চার সদস্যের। অভাব থাকলেও অশান্তি নেই তাদের। তবে একটি ঘটনা হাসি-আনন্দ সব কেড়ে নিয়েছে পরিবারটির।

এক মাস আগে বাড়ির উঠানে গরুর জন্য রাখা গরম জাউয়ের হাড়িতে পড়ে যায় শিশু সাকিবা। এতে তার শরীরের (পিঠ থেকে পা পর্যন্ত) অনেকটা অংশ পুড়ে যায়। 

স্থানীয় হাসপাতাল থেকে খুলনা মেডিকেল, সেখান থেকে বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৭০২নং ওয়ার্ডের ৬নং বেডে চিকিৎসাধীন সাকিবা। 

ঢাকায় পরিচিত কেউ না থাকায় হতভাগা বাবা এক ব্যাগ রক্ত কিনেছেন ১ হাজার ৬৫০ টাকা দিয়ে। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন তিনি।

গত ৩ সেপ্টেম্বর সকালে দুই বছর বয়সী সাকিবা ও চাচাতো বোন আড়াই বছর বয়সী মেহনাজ বাড়ির উঠানে খেলছিল। এক পর্যায়ে মেহনাজ ঘরে চলে গেলে সাকিবা গরম হাড়ির ওপরে রাখা হাড়িতে বসতে গেলে হাড়ির মধ্যে পড়ে যায়। তার কান্নার শব্দে দ্রুত তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় ঝনঝনিয়া হাসপাতালে নিয়ে যায় স্বজনরা। সেখানে ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে খুলনা নেওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় সেদিন আর যাওয়া হয়নি তাদের।

তিন দিন পর সাকিবার চাচা শেখ মনিরুজ্জামানের একটি গরু ৩৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তিন সপ্তাহের বেশি খুলনার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পরেও অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় ২৬ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয় তাকে। কিন্তু ততদিনে গরু বিক্রির ৩৮ হাজার টাকা ও স্থানীয়দের মাধ্যমে উত্তোলিত প্রায় ৮ হাজার টাকা শেষ হয়ে গেছে পরিবারটির।
 
সাকিবার বাবা শেখ শরিফুজ্জামান বলেন, ঘটনার সময় আমি দিনমজুরি কাজের চুক্তিতে ট্রলারে ছিলাম। সেখান থেকে খবর পেয়ে হাসপাতালে যাই। আমার বাচ্চাটার শরীরের অনেকখানি পুড়ে গেছে। কি যে কষ্ট পাচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারব না। সারাদিন ছোটাছুটি করে বেড়ানো সন্তানকে দিনের পর দিন বিছানায় ব্যান্ডেজ মুড়ানো দেখা কোনো বাবার পক্ষে সম্ভব না। আমার সেই সামর্থ্যও নেই যে ভালোভাবে চিকিৎসা করাবো। মেয়েকে বাঁচাতে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে মানুষের একটু সহযোগিতা ভিক্ষা চান তিনি।

সাকিবার চাচা শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, দুটি গরুর একটি বিক্রি করে আর মানুষের সহযোগিতায় এই কয়দিন চলেছি। শুনেছি মানুষ মানুষের জন্য কত কিছু করে। কিন্তু আমাদের এক ব্যাগ রক্তই (ও পজেটিভ) কিনতে হলো ১৬৫০ টাকা দিয়ে। দুই ভাই দিনমজুরির কাজ করে খাই। অল্প একটু ভিটেমাটি ছাড়া কোনো সহায় সম্পত্তিও নেই আমাদের। ঢাকা শহরে কাউকে চিনি না, কার কাছে যাব, কোথায় গেলে আমাদের বাচ্চাটা বাঁচবে বলে, ফোনে কথা বলার সময় এমন আহাজারি করতে থাকেন তিনি।

প্রথম দিন থেকেই বাচ্চাটির সার্বিক খোঁজখবর রাখছিলেন রামপালের গৌরম্ভা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের (কাপাসডাঙ্গা) সাবেক ইউপি সদস্য শেখ সেকেন্দার আলী। 

তিনি বলেন, ভুল চিকিৎসার কারণেই মূলত শিশুটির এই করুণ অবস্থা। পরিবারটিতে একদিকে চরম অর্থকষ্ট অপরদিকে শিক্ষিত না হওয়ায় ঝনঝনিয়া হাসপাতাল থেকে ফেরত দিলে তারা ওকে এক কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে দুইদিন থাকার পরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে গরু বিক্রি করে খুলনায় নিয়ে যায়।

খুলনাতেও তেমন চিকিৎসা না করে ব্যান্ডেজ করে রাখায় শরীরের পেছনের অংশ পুজ হয়ে অনেকটা পচে গেছে। শিশুটিকে বাঁচাতে সরকারি ও সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

এ বিষয়ে গৌরম্ভা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজিব সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশ কয়েকদিন আগে সাকিবার পরিবার আমার কাছে আসে। আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতাও করেছি। তবে চিকিৎসার জন্য  অনেক টাকা ব্যয় হবে বলে শুনেছি। এত টাকা হতদরিদ্র পরিবারটির পক্ষে বহন করা সত্যিই অসম্ভব। বিত্তবানদের একটু সহযোগিতা পেলে শিশুটি সুস্থ হয়ে মায়ের কোলে ফিরতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।


তানজীম আহমেদ/এমএএস