বর্তমান সময়ে গরুর জন্য ভয়ঙ্কর একটি রোগ হলো এলএসডি বা ল্যাম্পিস্কিন ডিজিজ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, যশোর জেলায় এ পর্যন্ত তিন থেকে চারটি গরুর এ রোগ দেখা দিয়েছে। 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, এ রোগ সম্পর্কে যশোরের খামারিদের ইতোমধ্যে সতর্ক করা হচ্ছে। বিভিন্ন পরামর্শ এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে যশোরের খামারিরা বলছেন এ রোগ সম্পর্কে তারা এখনও অবগত নন। এমনকি এ রোগ থেকে সতর্ক করতে এখনও পর্যন্ত জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর খামারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ফলে আতঙ্কে রয়েছেন খামারিরা। 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের সব জায়গায় অতিরিক্ত আকারে দেখা দিয়েছে গরুর এলএসডি বা ল্যাম্পিস্কিন ডিজিজ। এলএসডি গরুর জন্য একটা ভয়ঙ্কর ভাইরাস বাহিত চর্মরোগ। এ রোগ ছড়ানোর প্রধান কারণ অপরিষ্কার অপরিছন্ন খামারে গরু পালন। এই রোগের গড় মৃত্যুর হার আফ্রিকাতে ৪০ শতাংশ। আফ্রিকায় একাধিকবার মহামারি আকারে দেখা গেলেও বাংলাদেশের গরুতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কখনো মহামারি আকারে দেখা যায়নি। তবে সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছে। যশোরের পার্শবর্তী ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়াতেও এ রোগের ব্যাপক সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চিকিৎসকরা বলছেন, এটি মূলত এক প্রকার পক্স ভাইরাস বা এলএসডি ভাইরাসের সংক্রমণে গবাদিপশুতে এই রোগ দেখা দেয়। এক গরু থেকে আরেক গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানত বর্ষার শেষে, শরতের শুরুতে অথবা বসন্তের শুরুতে রোগটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

কথা হয় যশোর শহরের বেজপাড়ার রাবেয়া ডেয়রি ফার্মের স্বত্ত্বাধিকারী রওশানারা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, তার খামারে বর্তমানে ৩৮টি গরু রয়েছে। তিনি গরুর সর্বদা যত্ন নেন এবং রোগবালাই সম্পর্কে খেয়াল রাখেন। তবে বর্তমান সময়ে তিনি গরুর ল্যাম্পিস্কিন ডিজিজ রোগ বা এলএসডি রোগের নাম শুনলেও রোগ সম্পর্কে তিনি মোটেও অবগত নন। ফলে এ রোগ সম্পর্কে জানতে পেরে তিনি আতঙ্কে রয়েছেন। ভয়ঙ্কর এ রোগ সম্পর্কে সতর্ক করতে প্রাণিসম্পদ চিকিৎসকেরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলে দাবি তার।

যশোরের বসুন্দিয়ার খোদেজা এগ্রোর স্বত্ত্বাধিকারী কামাল হোসেন বলেন, এ রোগের নাম শুনেছি, তবে রোগ সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমার খামারে বর্তমানে ১৫টি গরু আছে। সামনের বছর কোরবানিকে টার্গেট করে আরও গরুর সংখ্যা বাড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নতুন নতুন রোগের নাম শুনে মনের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে এ রোগের বিষয়ে কর্মশালা করলে খামারিদের জন্য ভালো হয়।

যশোর সদর উপজেলার পদ্মবিলা গ্রামের খাদিজা ডেয়ারির স্বত্ত্বাধিকারী আব্দুল মান্নান বলেন, আমার খামারে একটি গরুর এ রোগ দেখা দিয়েছিল। আমি তৎক্ষণাৎ প্রাণিসম্পদ চিকিৎসকের স্বরণাপন্ন হই। বর্তমানে গরুটি সুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমার খামারে বর্তমানে ২৩টা গাভি রয়েছে। এ রোগ বিষয়ে খামারিদের আরও সতর্ক হওয়া লাগবে। অন্যথায় মহামারি আকার ধারণ করলে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে খামারিরা।

রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসার সম্পর্কে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, এলএসডি আক্রান্ত গরুর প্রথমে জ্বর হয়, খাওয়ার রুচি কমে যায়। নাক-মুখ দিয়ে লালা বের হয়। পা ফুলে যায়। সামনের দু’পায়ের মাঝখানে পানি জমে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গার চামড়া পিণ্ড আকৃতি ধারণ করে, লোম উঠে যায় এবং ক্ষত সৃষ্ট হয়। পাকস্থলী অথবা মুখের ভেতরে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে গরু পানি পানে অনীহা প্রকাশ করে। লাম্পিস্কিন ডিজিজ রোগে আক্রান্ত গরু থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে রোগটি অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান মাধ্যমগুলো হচ্ছে মশা, নালা, গাভীর দুধ ও ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। তবে, সবচেয়ে ভালো বিষয়- এই রোগে কেবল গরু-মহিষ আক্রান্ত হয়, মানুষ হয় না। এলএসডিতে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত গরুকে নিয়মিত এলএসডি ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত। দেশে এর আগে রোগটির প্রাদুর্ভাব কম দেখা গেছে তাই এই রোগের ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়। খামারের ভেতরের এবং আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, যেন মশা-মাছির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রান্ত খামারে যাতায়াত বন্ধ করা এবং আক্রান্ত খামার থেকে আনা কোনো সামগ্রী ব্যবহার না করা। আক্রান্ত গরুকে শেড থেকে আলাদা স্থানে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখা যাতে মশা মাছি কামড়াতে না পারে।

জানা যায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যশোরের আট উপজেলায় মশাবাহিত ‘লামপি স্কিন ডিজিজ’ এলএসডি নামের এ ভাইরাসজনিত -সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার গবাদি পশু। এর মধ্যে মৃত্যু হয় প্রায় অর্ধশতাধিক গবাদি পশুর। 

এ বিষয়ে যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. রাশেদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের যশোর জেলায় তিন থেকে চারটি গরু এলএসডি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে খামারিদের সতর্ক করা হচ্ছে। সরকারি ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা না থাকলেও বেসরকারিভাবে দুটি কোম্পানি এ ভ্যাক্সিন দিচ্ছে। এ রোগ থেকে এড়াতে খামারিদের সব সময় খামার পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে বলা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, যশোর জেলায় এ রোগ প্রতিরোধে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সতর্ক অবস্থানে আছে এবং প্রয়োজনীয় সচেতনতা মূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

এ্যান্টনি দাস অপু/এমএএস