সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী 'লাঠি খেলা'। তবে সেই হারানো ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার পশ্চিম দেওগ্রামের মানুষ।

প্রতি বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার দশমীর তিন দিন পর দেওগ্রামে লাঠি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার (৮ অক্টোবর) বসেছে এই লাঠি খেলার মেলা।

ঢোলের বাজনা, আর কাঁসার ঘণ্টার তালে তালে লাঠির কসরত। এদিকে প্রতিপক্ষের লাঠির আঘাত, আবারও পাল্টা আঘাত। এ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন লাঠিয়ালরা। আর সেখানে উপস্থিত শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সব বয়সী মানুষরা তাতে উৎসাহ দিচ্ছেন। এমনিভাবে শতাধিক বছর ধরে এখানে চলে ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা। এ উপলক্ষে এখানে মেলা বসে। লাঠি খেলা আর মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠেন গ্রামবাসীরা।

গ্রামবাসীরা জানান, শতাধিক বছর আগে থেকে এই লাঠি খেলার মেলা চলছে। প্রতি বছর দুর্গাপূজার দশমীর তিনদিন পর এই মেলা বসে। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করা হয়। মেলার দুদিন আগে থেকে আত্মীয়-স্বজনরা গ্রামে আসতে শুরু করে। মেলার দিন সকালে গ্রামে গরু জবাই করা হয়। আজকে মেলার দিন ১৪-১৫টি গরু জবাই করে মাংস ভাগবাটোয়াটা করে নেওয়া হয়েছে। এরপরও গ্রামের অনেকেই হাট বাজারে গিয়ে মাংস কিনে এনেছেন। 

মেলার দিন দুপুরে প্রতিটি বাড়িতে ধুমধামে খাওয়া দাওয়া হয়। মেলার দিন লাঠিয়ালেরা পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে লাঠি খেলা দেখান। বিকেল লোকজন মেলায় পুরোদমে কেনা-কাটা করেন। গভীর রাত পর্যন্ত মেলা চলে। তাছাড়া কাল দুপুর পর্যন্তও চলবে এই মেলা।

লাঠি খেলা দেখতে আসা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, আমার বাড়ি আক্কেলপুর উপজেলার রোয়াইড় গ্রামে। এ গ্রামে আমার নানার বাড়ি। তাই লাঠি খেলার মেলা উপলক্ষে আমার পুরো পরিবারকে দাওয়াত করা হয়। লাঠি খেলার মেলা আমাকে কিছুক্ষণের জন্য শৈশবে ফিরে নিয়ে যায়।

রব্বানি নামের এক বৃদ্ধ বলেন, অন্য কোনো উৎসবে জামাই-মেয়ে বা আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত না করলেও সমস্যা থাকে না। কিন্তু পূর্ব পুরুষদের রীতিনীতি অনুযায়ী লাঠি খেলার মেলায় তাদের দাওয়াত দিতেই হবে।

গ্রামের প্রবীণব্যক্তি আব্দুল গফুর বলেন, আমার বয়স এখন নব্বই বছর। আমি ছোট থেকেই আমাদের গ্রামে লাঠি খেলার মেলা দেখছি। এ মেলাকে ঘিরে আমাদের গ্রামে উৎসব বিরাজ করে। আত্মীয়-স্বজনেরা আসেন। গ্রামের রীতি অনুযায়ী তাদের খৈ, মুড়ি, নাড়ু ও মাংসভাত অ্যাপায়ন করা হয়। আজকে গ্রামে ১৪-১৫টি গরু জবাই হয়েছে। মেলা শেষ হওয়ার দুই-তিন মাস পর থেকে গ্রামের প্রায় সবাই গরু কেনার টাকা জড়ো করে রাখেন।

বৃদ্ধ লাঠিয়াল হাফিজার রহমান (৭২)। তিনি বলেন, আমার বাপ-দাদারা লাঠি খেলা করেছে। তাদের কাছ থেকে লাঠি খেলা শিখেছি। আমি ১৯৮০ সাল থেকে লাঠি খেলা করছি। আমাদের লাঠি খেলা দেখে লোকজন আনন্দ পায় তাতে আমরা খুশি হই।

কিশোর লাঠিয়াল স্বাধীন হোসেন (১৬) বলে, আমার বাবা লাঠি খেলা করে। আমি তার কাছ থেকে লাঠি খেলা শিখেছি। এখন নিজেই লাঠি খেলা করি। আমাকে লাঠি খেলা করতে খুব ভালো লাগে।

দেওগ্রাম লাঠি খেলা মেলা কমিটির সভাপতি ছাইদার রহমান বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে মেলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। এ মেলার বয়স অনেক। এবারও মেলা জমজমাট হয়েছে। মেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো।

মামুদপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও দেওগ্রাম পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা মশিউর রহমান বলেন, এই মেলা একশ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। মূল মেলা একদিন তবে পরের দিনও দুপুর পর্যন্ত মেলা থেকেই যায়। এই লাঠি খেলাটি যেন গ্রাম থেকে হারিয়ে না যায়, তার জন্য গ্রামের মানুষরা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

চম্পক কুমার/এমএএস