বীরাঙ্গনা সুইটি আক্তার পুতুল

মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বর্বর পাশবিক নির্যাতনের শিকার অসহায় এক বীরাঙ্গনার আবেদন ঝুলে আছে প্রায় এক বছর ধরে। ভুক্তভোগী বীরাঙ্গনার আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রংপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বরং কোরাম পূরণ করতে না পারার অজুহাত আর নানা ছুতোয় ঝিমিয়ে পড়েছেন কমিটির সদস্যরা।

এমন পরিস্থিতিতে কালক্ষেপণ না করে বিষয়টি গুরুত্বসহ আমলে নিতে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় দিনাতিপাত করা বীরাঙ্গনা সুইটি আক্তার পুতুল।

ভুক্তভোগী নারী ও প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা গেছে, রংপুর মহানগরীর ২৭ নং ওয়ার্ডের মুসলিমপাড়ার বাসিন্দা প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইসাহাক আলী ওরফে টেঙ্গারু মিয়ার মেয়ে সুইটি আক্তার পুতুল। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তিনি নির্যাতনের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পর সম্ভ্রম হারানো নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-জামুকায় বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করেন সুইটি আক্তার পুতুল। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) কর্তৃপক্ষ রংপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বীরাঙ্গনা যাচাই-বাছাইয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন।

এরই প্রেক্ষিতে রংপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বীরাঙ্গনা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু কমিটি গঠনের প্রায় এক বছর হলেও এখন পর্যন্ত নানা কারণে কমিটির সদস্যরা একত্রিত হতে না পারায় কোরাম পূরণ হয়নি। কোরাম পূরণ না হওয়া ছাড়া তদন্ত বিলম্বে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা- এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি উপজেলা প্রশাসন।

ভুক্তভোগী সুইটি আক্তার পুতুল বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা ইছাহাক আলী ওরফে টেঙ্গারু মিয়া ছিলেন রংপুরের আলমনগর রেলস্টেশন এলাকার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতাসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। সেই ক্ষোভেই স্থানীয় ওয়াহেদ মিয়া নামে এক পাকিস্তানি দোসর আমাকে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে তাদের কাছে বাহবা নিয়ে সটকে পড়েন। সেই থেকে আমি চার মাস পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর হাতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। যুদ্ধ শেষে ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে উদ্ধার করে আমার পরিবারের হাতে তুলে দেয়। সেই সময়ে আমার বাবা পরিবারের সম্মানহানির ভয়ে এ ঘটনা আড়াল করে বিষয়টি গোপন রাখেন। 

তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর আগে মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার নির্দেশনা দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশ পুনর্বাসন সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এমএ সামাদ সরকার আমাকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সনদ প্রদান করেন। তারপর থেকে আমি সেই রাজাকার ওয়াহেদ মিয়াকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলন করেছি। এ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশও হয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রংপুর সদর উপজেলা কমান্ডার ও ইউনিট কমান্ডার বিগত ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ আমাকে বীরাঙ্গনা নারী হিসেবে সুপারিশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করেছিলেন।

এই বীরাঙ্গনা বলেন, আমার ভোটার আইডি কার্ডে জন্ম সাল ১৯৫৩ সালের পরিবর্তে ভুলবশত ১৯৭৪ সাল হওয়ায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আমার বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির আবেদন বাতিল করে দেয়। এরপর ভোটার আইডি কার্ডে থাকা ভুল সংশোধন করতে দীর্ঘ কয়েক বছর সময় লেগে যায়। অবশেষে ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর সংশোধিত আইডি কার্ড দিয়ে আমি পুনরায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে নতুন করে আবেদন করি। জামুকা কর্তৃপক্ষ আমার আবেদনটি গুরুত্বসহ আমলে নিয়ে রংপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বীরাঙ্গনা যাচাইয়ের জন্য নির্দেশনা দেয়। আজ প্রায় এক বছর অতিবাহিত হলেও আবেদনটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

এ বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের ২৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হারুন অর রশিদ হারুন বলেন, আমি নিজেই অনেকবার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। তারপরও তিনি এ বিষয়টি আমলে নেননি। একজন অবহেলিত বীরাঙ্গনার যাচাই-বাছাই হয় না, এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রভাবশালী কথিত কিছু মুক্তিযোদ্ধা ওই রাজাকারের টাকা খেয়ে পুতুলের প্রতি অবিচার করেছে। তবে নিঃসন্দেহে পুতুল একজন বীরাঙ্গনা নারী। তার বাবা স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা ছিলেন।

এ বিষয়ে মুজিব ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর হোসেন চাঁদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা ছিলেন ইছাহাক আলী টেঙ্গারু মিয়া। তার মেয়ে পুতুল পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পুতুলের আবেদনটি কী কারণে আটকে রাখা হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়। কোনো একটি চক্র তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্র করছে বলে মনে হচ্ছে।

এদিকে খোঁজ জানা গেছে, পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট বীরাঙ্গনা যাচাই-বাছাই তদন্ত কমিটি গত এক বছরে একবারও কোরাম পূরণ করতে পারেনি। এই কমিটিতে কারা‌ রয়েছেন এবং কত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা করতে হবে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে রাজি হয়নি উপজেলা প্রশাসন। 

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. নুর নাহার বেগম বলেন, আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তবে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করছি না। ইতোমধ্যে তদন্তে‌ সহযোগিতা করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছ থেকে দুইজন নারী বীর মুক্তিযোদ্ধাকে চেয়েছি। তবে কেন তদন্তে বিলম্ব এবং কোরাম পূরণ হচ্ছে না, এটিও খতিয়ে দেখা হবে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করবে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর