প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য অঞ্চল। এখানকার অধিকাংশ মানুষ দুর্গম এলাকায় বসবাস করে যেখানে মৌলিক সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো দুরূহ। এমনকি কিছু প্রত্যন্ত গ্রামে এখনো পৌঁছেনি বিদ্যুতের মতো সুবিধা। সেসব প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের কাছে শিক্ষার আলোসহ মৌলিক সেবা পৌঁছে দিচ্ছে ‘পাড়াকেন্দ্র’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও ইউনিসেফের সহায়তায় পার্বত্য জেলার দুর্গম ও প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় ৪ হাজার ৮০০টি পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় আড়াই লাখ জনগোষ্ঠীকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্য, পুষ্টি উন্নয়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহ, পয়ঃব্যবস্থা উন্নয়ন, সংক্রমক ব্যাধি, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও নির্যাতন প্রতিরোধসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি নানা মৌলিক সেবাও পৌঁছে দিচ্ছে পাড়াকেন্দ্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া, লুসাইসহ ১৪টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এসব জনগোষ্ঠীর শিশুদের নিজেদের মাতৃভাষার পাশাপাশি খেলাধুলার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কাজ করছে পাড়াকেন্দ্র। নিজেদের ভাষার পাশাপাশি এসব শিশুদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য জানাতে এবং নানাবিধ মৌলিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ২০১৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় শুরু হয়েছিল এই পাড়াকেন্দ্র। যেসব এলাকায় এখনো পর্যন্ত কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেনি সেসব জায়গায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব কার্যক্রমে খুশি সেসব এলাকার বাসিন্দারা।

৫ নং ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ও ওই ইউনিয়ন পাড়াকেন্দ্রের সহ-সভাপতি আপাই মারমা বলেন, পাড়াকেন্দ্রে শুধু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাই প্রদান করা হয় না, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখানে উঠান বৈঠক করা হয় নিয়মিত। একজন শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তৈরি করে এই পাড়াকেন্দ্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুরা যা পড়ে, তা পাড়াকেন্দ্রেই শিশুদের নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে পাড়ানো হয়। এতে শিশুদের মধ্যে স্কুল ভীতি আর থাকে না এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাটা সহজতর হয়ে ওঠে।

ওয়াগ্গা মুরালীপাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রুনুংচিং মারমা বলেন, আমি আমার মেয়েকে আড়াই বছর বয়সে মুরালীপাড়া পাড়াকেন্দ্রে ভর্তি করিয়েছি। এখানে সে নিজের মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় কবিতা, গল্প শিখতে পারছে। ওর মধ্যে স্কুল ভীতিটা আর কাজ করে না। এতে আমি খুবই খুশি।

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি কিশোরী এবং নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করে পাড়াকেন্দ্র। উঠান বৈঠক, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এসব মৌলিক সুবিধা প্রদান করেন পাড়াকেন্দ্রের মাঠ সংগঠক ও পাড়াকর্মীরা।

পাড়াকেন্দ্রের মাঠ সংগঠক মঙ্গল শোভা চাকমা বলেন, আমরা মূলত এই পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মীদের মাধ্যমে দুর্গম এলাকাগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি বিষয়ক সেবাগুলো প্রদান করে থাকি। পাশাপাশি আমরা বাড়ি পরিদর্শন ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেই।

পাড়াকর্মী সুজলা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা উঠান বৈঠকে এলাকার প্রসূতি, গর্ভবতী ও কিশোরীদের অংশগ্রহণ করানোর সঙ্গে শিশুদের অভিভাবকদেরও রাখি। বৈঠকে আমরা স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিশু সুরক্ষা এই তিনটি বিষয়ের ওপর খুব জোর দেই। স্বাস্থ্যের মধ্যে টিকা দেওয়া, নিয়মিত চেকাপ করানো, পুষ্টির মধ্যে সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং শিশু সুরক্ষার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, টিকা দেওয়ার বিষয়গুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। এলাকার অনেক কিশোরী এই পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক তথ্য পাচ্ছে।

কাপ্তাই উপজেলা নোয়াপাড়া পাড়াকেন্দ্রের হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার ফুলবানু তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী, প্রসূতি, নবজাতকদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা দিয়ে থাকি। ওদের ওজন, উচ্চতাসহ খাদ্য অভ্যাস ও সংক্রামক নানা রোগ থেকে কিভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখবে সেই বিষয়ক প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করে থাকি।

কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের মিতিঙ্গ্যাছড়ি পাড়াকেন্দ্রের কিশোরী লিডার সায়মা খাতুন বলেন, আমি এই পাড়াকেন্দ্র থেকেই আমার শিক্ষা জীবন শুরু করেছিলাম, এখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। আমি এই পাড়াকেন্দ্রের কিশোরী লিডারের দায়িত্বও পালন করছি। আমরা এলাকাতে বাল্যবিবাহ, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, শিশুশ্রম প্রতিরোধ, বিশুদ্ধ পানি, আয়রন ট্যাবলেট, বয়ঃসন্ধিকাল এসব ব্যাপারে কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে থাকি।

তবে পার্বত্য জেলাগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কতৃক বাস্তবায়নকৃত এই প্রকল্পটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দাতা সংস্থা ইউনিসেফ আগ্রহ প্রকাশ করে বারবার চিঠি দিলেও উন্নয়ন বোর্ড সেই চিঠির জবাব দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক সভায় দেওয়া নির্দেশনা অনুসারে বোর্ড কতৃপক্ষ কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না পাঠানোয় প্রকল্প কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৩০ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিত্তিক এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চিরঞ্জীব তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি বিষয়ক নানান সুবিধা পাচ্ছি। পাশাপাশি পাড়াকেন্দ্র শিশু কিশোরদের জন্ম নিবন্ধন তৈরিতেও আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। তাই সরকারের কাছে আমার দাবি, এই প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রকল্পটি চলমান রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

এই বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বলেন, এই প্রকল্পটি যাতে চলমান থাকে সেজন্য আমরা ইতোমধ্যে ডিপিপি তৈরি করেছি, যা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবো। আমি বিশ্বাস করি, সরকার এটাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করবে এবং প্রকল্পটি পাস করবে। প্রকল্পটি পাস হলে আমরা আগের মতোই প্রকল্পটিকে চলমান রাখতে পারব।

প্রসঙ্গত, পাড়াকেন্দ্র কার্যক্রমের শুরুতে শতভাগ ব্যয়ভার দাতা সংস্থা ইউনিসেফ গ্রহণ করলেও ক্রমান্বয়ে সরকারের অংশভাগ বেড়েছে। বর্তমানে সরকার ৭৪ শতাংশ এবং ইউনিসেফ কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি ২৬ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করছে।

মিশু মল্লিক/এসপি