রাজবাড়ীতে গোল্ডেন লাইফ ইনসুরেন্স নামে একটি বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার গ্রাহকের প্রায় দুই কোটি টাকা না দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কয়েক বছর আগেই বীমার মেয়াদ শেষ হলেও টাকা পরিশোধ না করে নানা টালবাহানা শুরু করে কোম্পানি। এমনকি কোম্পানির দ্বারে দ্বারে ঘুরে টাকা ফেরত না পেয়ে হতাশ গ্রাহকরা।

এ ঘটনায় কয়েকজন গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা ফেরত চাইলে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা গ্রাহকদের মধ্যে মাত্র ১০ জনকে চেক প্রদান করেছিল কোম্পানিটি। তবে তার হিসাব নম্বরে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ওই চেকগুলো ব্যাংক থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়।

পরবর্তীতে কয়েকজন গ্রাহক উকিল নোটিশ করার পর ওই সমস্ত ডিজওনার চেকের পরিবর্তে পে-অর্ডারের মাধ্যমে কোম্পানি ওই ১০টি চেকের টাকা পরিশোধ করে। এখনো কোম্পানির অনুকূলে পাঁচ হাজারেরও বেশি গ্রাহক অন্তত দুই কোটি টাকা পাবেন। যা কোম্পানির মালিক পক্ষ এবং পরিচালনা পর্ষদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশে ফেরত দিচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন গ্রাহকরা।

জানা গেছে, রাজবাড়ীতে ২০০২ সালে গোয়ালন্দ উপজেলার বাসিন্দা ও স্থানীয় এনজিও কেকেএস এর কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনের সহযোগিতায় গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কার্যক্রম শুরু হয়। নাসির উদ্দিন এই কোম্পানির জেলার মুদারাবা প্রকল্পের জেলা ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে বিমার কার্যক্রম শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিমা কোম্পানিটি রাজবাড়ী জেলায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার গ্রাহক তৈরি করে। গ্রাহক তৈরির সময় বিমা কোম্পানি জানিয়েছিল, বিমা করার পর ১০ বছর মেয়াদ পূর্তিতে গ্রাহকদের জমাকৃত টাকা কোম্পানির প্রদেয় আইন অনুযায়ী দেড় গুণ লাভসহ ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু ১০ বছর মেয়াদ পূর্তির পরও গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পায়নি।

রাজবাড়ী শহরের বিনোদপুর ভাজনচালা এলাকার গৃহিণী হাসিনা খাতুন জানান, তিনি ২০০৭ সালে গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে ১০ বছর মেয়াদী বিমা করেন। প্রতি মাসে কিস্তির মাধ্যমে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৪ হাজার টাকা জমা করেন তিনি। পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে চার বছর। কিন্তু কোনোভাবেই টাকা তুলতে পারছেন না তিনি। অফিসে গেলে বেশিরভাগ সময়ই অফিস তালাবদ্ধ দেখতে পান।

শেফালী রাণী সরকার নামে আরেক গ্রাহক জানান, তার স্বামী নেই। ২০০৭ সালে তিনি গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে বিমা করেন। প্রাইভেট টিউশনি করে যা আয় করতেন তা দিয়ে তিনি একটি বিমা করেন। তার বিমার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৭ সালে। কিন্তু বিমা অফিসে বহুবার ঘুরেও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় চরম আর্থিক সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। দ্রুত তিনি তার বিমা পলিসির টাকা ফেরত চান।

গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির রাজবাড়ী শাখার ম্যানেজার ওয়াহিদুল আক্তার মিন্টু বলেন, হেড অফিস যদি টাকা না দেই, তাহলে আমাদের কী করার আছে বলেন। আমরা এই বিষয় নিয়ে ঢাকা হেড অফিসে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি কিন্তু কাজ হয়নি। গ্রাহকরাও কয়েকবার ঢাকা হেড অফিসে গিয়েছে কিন্তু তাদের কথাও কোনো কর্মকর্তা শুনেননি। বরং হেড অফিসে গেলে তারা আমাদের ও গ্রাহকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে।

কবির হোসেন নামে গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির একজন মাঠকর্মী বলেন, আমি নিজেও কোম্পানিতে ৬০ হাজার টাকার একটা পলিসি করি। মেয়াদ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত টাকা ফেরত পাইনি। আমি কয়েকবার ঢাকার হেড অফিসে গিয়েছি। কিন্তু তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। এখন হেড অফিসে গেলে আমাকে আর ঢুকতে দেই না। এছাড়া গ্রাহকরা আমার বাড়িতে এসে নানা রকম ঝামেলা শুরু করছে।

গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির রাজবাড়ী জেলা ইনচার্জ নাসির উদ্দিন বলেন, কর্মীরা আমার ওপর যে অভিযোগ করেছে সেটা সত্য নয়। আমাদের এখানে প্রায় পাঁচ হাজার গ্রাহক ছিল। তাদের মধ্যে দেড় হাজার গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এখনো প্রায় তিন হাজার গ্রাহক টাকা পাবে। টাকার পরিমাণ হবে এক কোটি টাকা। কিন্তু কোম্পানি আমাদের ঘোরাচ্ছে। তারা আবার নতুন করে রাজবাড়ীতে শাখা চালু করতে বলে। কিন্তু গোল্ডেন লাইফের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে কেউ কাজ করতে চায় না।

তিনি আরও বলেন, গ্রাহকদের কাছে কোম্পানির টাকা জমা দেওয়ার দলিল আছে। তারা চাইলে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। গ্রাহকরা যদি মামলা করে তাহলে আমি তাদের সহযোগিতা করব।

গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির রাজবাড়ী শাখার হিসাবরক্ষক মো. শফিউজ্জামান বলেন, পাঁচ থেকে ছয় হাজারের বেশি গ্রাহক কোম্পানির কাছে দুই কোটি টাকার ওপরে পাবে। গ্রাহকদের চাপে আমরা অফিস খুলতে পারছি না। কোম্পানির ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা স্থায়ীভাবে রাজবাড়ীর অফিসটি বন্ধ করে দেবে এবং আমাকেও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেবে বলে জানিয়েছে।

রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান বলেন, এ বিষয়ে আমি এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। যদি লিখিত অভিযোগ পাই, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

মীর সামসুজ্জামান/এসপি