২৮ বছর আগে মৃত্যু হয় পরশ চন্দ্রের। সে সময় তার দাহও হয়েছিল। এর ১১ বছর পর তিনি ‘বেঁচে’ ওঠেন। শ্মশান থেকে বাড়িতে না এসে তিনি সোজা চলে যান সোনালী ব্যাংকে। পরিবার, স্বজন কিংবা এলাকাবাসীর কারো সঙ্গে তার দেখা হয়নি। ব্যাংকে গিয়ে পরেশ ‘ঋণ নেন’। মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পর সেই ঋণের নোটিশ পেয়েছে তার পরিবার। নোটিশ পেয়ে হতভম্ব পরিবারের সদস্যরা।  

জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে। আলমপুর ইউনিয়নের পাঁচুইল গ্রামের কৃষক পরেশ চন্দ্র ১৯৯৪ সালে মারা যান। কিন্তু ২০০৫ সালে তার নামে ১০ হাজার টাকা এমসিডি ঋণ নেওয়া হয়েছে— এমন দাবি করে তার পরিবারের কাছে সম্প্রতি ঋণের টাকা পরিশোধের নোটিশ পাঠিয়েছে সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখা।

ঋণ পরিশোধ না করলে নোটিশে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়। নোটিশে মৃত পরেশের ঋণ নেওয়ার তারিখ উল্লেখ আছে ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর। অথচ পরেশের মৃত্যু হয়েছে ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন। 

ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করা সোনালী ব্যাংকের এমন নোটিশ পেয়ে নরেশ চন্দ্র ব্যাংকে যোগাযোগ করেন। তিনি বাবার মৃত্যুর প্রমাণপত্র ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দেখান। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নরেশ চন্দ্রকে নথিপত্র দেখে জানায়, ঋণ নেওয়ার তারিখসহ তার বাবার নাগরিকত্ব সনদ, ছবি, জমির কাগজপত্র ও স্বাক্ষর সবই ঠিক আছে।

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ৩২৮ নম্বর এমসিডিতে পরেশ চন্দ্রের নামে দশ হাজার টাকা ঋণ রয়েছে। এ সময় ছবি দেখে নরেশ ছবিটি তার বাবার নয় বলে দাবি করলেও কাগজপত্র এবং ঋণ আবেদনে সই থাকায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে বাবার ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

পরেশের মৃত্যুর বিষয়টি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মৃত্যু রেজিস্টারেও উল্লেখ রয়েছে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বুকের ব্যথার কথা উল্লেখ রয়েছে। আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০২১ সালের ৯ মার্চ ছেলে নরেশ চন্দ্রকে তার বাবার মৃত্যু সনদ দেওয়া হয়েছে। ওই সনদেও মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন উল্লেখ করা হয়েছে।

মৃত পরেশ চন্দ্রের ছেলে নরেশ চন্দ্র বলেন, আমার বাবা ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। ১১ বছর পরে তিনি কিভাবে জীবিত হয়ে লোন তুলতে পারেন? আমার বাবার মৃত্যুর ২৬ বছর পরে নোটিশ পেয়ে সবাই তো হতবাক হয়ে গেলাম এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এটার আমরা সঠিক তদন্ত চাই।

একই গ্রামের আরেকজন নরেশ চন্দ্র ও সুধান্ন চন্দ্রের নামেও এসেছে ব্যাংকের নোটিশ। নোটিশে যথাক্রমে কৃষি বা এমসিডি ঋণের ১৫ হাজার টাকা ও ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলেছে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।  

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নরেশ চন্দ্র খুবই দরিদ্র। অন্যের বাড়িতে দিনমজুর কাজ করে জীবিকানির্বাহ করেন। তার নিজের নামে কোন জমিও নেই। অন্যের বাড়িতে থাকেন। বাবা-মাও নেই নরেশের। অন্যদিকে, সুধান্ন চন্দ্রের বিঘা খানেক জমি আছে। তিনিও কৃষি কাজ করেন। ব্যাংকের চাপে তিনি ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন।

নরেশ চন্দ্র বলেন, আমি গরীব মানুষ, জমিজমা নেই। অন্যের বাড়িতে থাকি, নিজের বাড়ি নেই। আমি ঋণ নিইনি, অথচ এই নোটিশ কীভাবে এলো। নোটিশের টাকা কোথা থেকে জোগাড় করব?

সুধান্নের স্ত্রী যমুনা রানী বলেন, আমার স্বামী বলেছে সে এই ঋণ নেয়নি। সোনালী ব্যাংকে গেলে অফিসাররা তাকে বলে আপনার নামে লোন গেছে, আপনাকে দিতেই হবে। আমার স্বামী বাড়িতে এসো উপায় না পেয়ে ওই টাকা পরিশোধ করে।

তিনি বলেন, পুলিশের ভয়ও আমাদের আছে, যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ওই জন্য টাকা পরিশোধ করে। এখন আমরা সোনালী ব্যাংকের কাছে আবেদন জানাই, এই টাকা যেন আমরা ফেরত পাই। এর সঠিক বিচার যেন হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা জিতেন চন্দ্র বলেন, মারা যাওয়া ব্যক্তি এসে কীভাবে সোনালী ব্যাংক থেকে লোন নেয়? এর সুষ্ঠু বিচার আমরা চাই।

শ্রী চন্দন নামের আরেকজন বলেন, সোনালী ব্যাংক একটি সরকারি ব্যাংক। তারা সঠিকভাবে তদন্ত না করে কীভাবে ঋণ দেয়? একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার ১১ বছর পর ঋণ নিয়েছেন। এটি কীভাবে হয়? যারা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তাদের বের করা হোক।

আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোনালী ব্যাংকের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আমার ইউনিয়নের কিছু টাউট-বাটপার মিলে এভাবে ইউনিয়নের বিভিন্ন লোকের সঙ্গে ঋণের নামে প্রতারণা করেছে। ঋণ না নিয়েও তাদের নামে ঋণ ইস্যু হয়ে আছে। আমি বিষয়টির উচ্চতর তদন্তের পাশাপাশি ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরেশ চন্দ্র নামে এক ব্যক্তি ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণ পরিশোধের জন্য নোটিশ দিয়েছি। এর তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্ত করে দেখে সত্যতা না থাকলে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর আমি ওই (ঋণ প্রদান) সময় ছিলাম না। শুধু নোটিশ দিয়েছি।তদন্তে যে দোষী হবে, তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। তাছাড়া অন্য যাদের নামে গিয়েছে, তারা যেন ব্যাংকে যোগাযোগ করেন।

আরএইচ